জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংশ্লিষ্ট তথ্য যাচাইয়ের জন্য ‘পরিচয়’ প্ল্যাটফর্ম চালু করেছিল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ।
এই তথ্য পেতে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ দিতে হয় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে।
তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিশোধিত অর্থের ৮৬ শতাংশই যেত ডিজিকন গ্লোবাল সার্ভিসেস নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পকেটে।
‘তথ্য নাগরিকের, তথ্যভান্ডার সরকারের’ হলেও সেই তথ্য বিক্রির সিংহভাগ আয় নিয়ে যেত ডিজিকন।
এভাবে ডিজিকনের নামে শত শত কোটি টাকা অর্জিত অর্থের বড় অংশ পেতেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঊর্ধ্বতন ঘনিষ্ঠ মহল।
প্রতিষ্ঠানটিকে একচেটিয়াভাবে সরকারি তথ্যভান্ডারের প্রবেশাধিকার পাইয়ে দেওয়ার ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিলেন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) সাবেক পরিচালক এবং ফোর-টায়ার জাতীয় ডাটা সেন্টার প্রকল্পের পরিচালক তারেক এম বরকতউল্লাহ।
কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই ‘পরিচয়’ নামে তথ্য বিক্রির সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ডিজিকনকে।
তথ্য বিক্রি থেকে অর্জিত লভ্যাংশ হিসেবে চুক্তিমাফিক অর্থ পায়নি সরকারি সংস্থাও।
বিসিসির অধীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডিজিটাল আর্কিটেকচারের (বিএনডিএ) আওতায় ২০১৯ সালের জুলাইয়ে যাত্রা শুরু করে ‘পরিচয়’।
আরও পড়ুন
তবে এর মূল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ছিল ডিজিকন। ডিজিকনকে দিয়ে ভেরিফিকেশন সার্ভার বানায় বিসিসি।
আইসিটি বিভাগের একটি সূত্র জানায়, বিসিসির তৎকালীন পরিচালক তারেক বরকতউল্লাহর ‘ধূর্ত’ পরিকল্পনায় কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই ‘পরিচয়’-এর আড়ালে এই কাজ দেওয়া হয় ডিজিকনকে।
দরপত্র প্রক্রিয়া এড়াতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কর্তৃপক্ষকে পাশ কাটিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির (সিসিইএ) মাধ্যমে ডিজিকনকে পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত করেন তারেক।
এই পুরো প্রক্রিয়ার ‘টার্মস অব রেফারেন্স (টর)’ তৈরি করেন তিনি।
সূত্র বলছে, ডিজিকনের আয়ের একটি মোটা অংশ পেতেন তারেক বরকতুল্লাহ।
২০২০ সালের করোনা মহামারির সময় টিকাদান কার্যক্রমের জন্য ‘সুরক্ষা’ প্ল্যাটফর্ম তৈরি হলে এনআইডি তথ্য যাচাইয়ে তথ্যভান্ডারর তুলে দেওয়া হয় ‘পরিচয়’ তথা ডিজিকনের কাছে।
এভাবেই প্রায় ১১ কোটি নাগরিকের তথ্যের ‘আলাদিনের চেরাগ’ পান ডিজিকনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওয়াহিদুর রহমান শরীফ।
এনআইডির তথ্য যাচাইকারী হিসেবে ‘পরিচয়’ প্ল্যাটফর্মের দায়িত্ব শুধু কাঙ্ক্ষিত তথ্যের সত্যতা যাচাই করা।
তবে তথ্যভান্ডারের ‘এক্সেস’ (প্রবেশাধিকার) নিয়ে ডিজিকন সেই তথ্য পড়তে (রিড) এবং সংরক্ষণ (স্টোর) করতে শুরু করে।
এর প্রমাণ পাওয়া যায় ‘পরিচয়’ এর নিজস্ব ওয়েবসাইটে।
সেবাপ্রত্যাশী প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্যে ওয়েবসাইটে পাঁচ ধরনের সেবার উল্লেখ আছে।
বিষয়টি কারিগরি দিক উল্লেখ করে একজন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বলেন, তাদের প্রথম সেবা ‘বেসিক’, যেখানে শুধু তথ্য যাচাই হবে।
এটাই মূলত পরিচয়ের কাজ। অর্থাৎ কোনো সংস্থা এনআইডি-সংশ্লিষ্ট তথ্য জানতে চাইলে সার্ভারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখবে ‘পরিচয়’।
এরপর সেবাপ্রত্যাশী শুধু ফলাফল জানাবে যে, প্রদান করা তথ্য সঠিক না ভুল।
কিন্তু ‘পরিচয়’ প্ল্যাটফর্মটি ‘অটোফিল’ সেবাও দিচ্ছে। অর্থাৎ সেবাপ্রত্যাশী শুধু এনআইডি নম্বর দিলে ‘পরিচয়’ নিজেই ‘কেওয়াইসি’ ফরম পূরণ করে দিচ্ছে।
এর অর্থ হলো, পরিচয়ের কাছে তথ্যভান্ডারের উপাত্ত সংরক্ষিত আছে।
যেমন মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদানকারী (এমএফস) প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের সেবা বেশি নেয়।
কারণ ‘অটোফিল’-এর মাধ্যমে নতুন গ্রাহকের তথ্য যাচাই এবং ‘কেওয়াইসি’ ফর্মে অন্যান্য তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসে।
পরিচয়ের কাছে তথ্য না থাকলে সে ‘অটোফিল’ করতে পারত না।
জানা যায়, প্রাথমিকভাবে তথ্য যাচাইয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ২ টাকা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ৫ টাকা চার্জ করত ‘পরিচয়’।
পরবর্তী সময়ে শুধু তথ্য যাচাইয়ে ১০ টাকা, অটোফিলের জন্য ১৫ টাকা এবং অটোফিলের পাশাপাশি এনআইডির সঙ্গে ছবি যাচাইয়ের (ফেসম্যাচ) জন্য ২৫ টাকা করে চার্জ করে ‘পরিচয়’।
এই অর্থের ৮৬ শতাংশই পেত ডিজিকন এবং ৭ শতাংশ করে পেত বিসিসি এবং নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
তবে ৭ শতাংশ হারেও ঠিকমতো অর্থ পরিশোধ করা হয়নি সরকারি সংস্থাগুলোকে।
সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে ডিজিকনের এমডি ওয়াহিদ শরিফ জানিয়েছিলেন, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ২০০ প্রতিষ্ঠানকে ১৯ কোটি সেবা দিয়েছে ‘পরিচয়’।
সেই হিসাবে প্রতিটি সেবা গড়ে ২০ টাকা ধরলে আয় হয় প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এর ৭ শতাংশ হিসাবে অন্তত ২৮ কোটি টাকা পাওয়ার কথা বিসিসির।
তবে আইসিটি বিভাগের সূত্র বলছে, এ পর্যন্ত প্রায় ৮ কোটি টাকা বিসিসিকে দিয়েছে ডিজিকন।
সূত্রটি জানায়, ‘পরিচয়’ প্ল্যাটফর্মে কোনো এক্সেস নেই খোদ বিসিসির। ফলে বিসিসি জানে না, পরিচয় থেকে কতগুলো সেবা দেওয়া হয়েছে এবং কী পরিমাণ অর্থ আয় হয়েছে।
ডিজিকনের দেওয়া হিসাবেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় সরকারি সংস্থাটিকে। যে অর্থ এ পর্যন্ত বিসিসি পেয়েছে, সেটিও অনেকবার তাগাদা দেওয়ার পর আদায় হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া ‘প্রি-পেইড ওয়ালেট সিস্টেম’ পরিচালনা করছে ডিজিকন।
বিষয়টির কারিগরি দিক ব্যাখ্যা করে এক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বলেছেন, যেসব প্রতিষ্ঠান ‘পরিচয়’ এর মাধ্যমে তথ্য যাচাই সেবা নেয়, তারা পরিচয়ের একটি ওয়ালেটে আগে থেকেই অর্থ সঞ্চিত রাখে।
সেবা নেওয়া হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রি-পেইড ওয়ালেট থেকে টাকা কাটতে থাকে।
এমন ওয়ালেট পরিচালনা করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি বা লাইসেন্স নিতে হয়। কিন্তু তাদের (ডিজিকন) সেটি নেই।
সরকারি সংস্থার পরিচয়ে এবং সাবেক সরকারের প্রভাবশালীদের মদদে এমন অনিয়ম করছিল ডিজিকন।
নাগরিকদের তথ্য বিক্রির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বিসিসির চুক্তিও ভঙ্গ করছিল প্রতিষ্ঠানটি।
২০২২ সালের অক্টোবরের সেই চুক্তি অনুযায়ী, কমিশনের তথ্য-উপাত্ত কোনো অবস্থাতেই অন্য কোনো ব্যক্তি, সত্তা, পক্ষ বা প্রতিষ্ঠানকে হস্তান্তর, বিনিময়, বিক্রয় কিংবা অন্য কোনো পন্থায় দেওয়া যাবে না।
এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে বিসিসিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে।
এ ছাড়াও ‘পরিচয়’ ব্যবহার করে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য নিতে মোবাইল টেলিকম অপারেটরগুলোকে কয়েকবার তাগিদ দিয়েছিল বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন।
একই সেবা ৫ টাকায় নির্বাচন কমিশনের তথ্যভান্ডার থেকে নিচ্ছিল অপারেটরগুলো।
তবে বিটিআরসির তাগিদ অনুযায়ী, ‘পরিচয়’ থেকে সেবা নিতে অপারেটরগুলোর গুনতে হতো ১০ টাকা।
সূত্র বলছে, ডিজিকনকে বাড়তি সুবিধা দিতেই সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের উদ্যোগে অপারেটরগুলোকে এই চিঠি দিয়েছিল কমিশন।
এসব বিষয়ে ডিজিকনের এমডি ওয়াহিদ শরীফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়েও তার পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
বিসিসির বর্তমান নির্বাহী পরিচালক ড. সানোয়ার জাহান ভূঁইয়াকেও মোবাইল ফোনে কল করে পাওয়া যায়নি।
নিজেদের আর্থিক উদ্দেশ্য চরিতার্থে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঊর্ধ্বতন একটি পক্ষ ডিজিকনকে নাগরিকদের উপাত্ত নিয়ে ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছিল বলে মনে করেন তথ্যপ্রযুক্তি খাত সংশ্লিষ্টরা।
এমন সংবেদনশীল তথ্য অনাকাঙ্ক্ষিত কারও আয়ত্তে থাকা উদ্বিগ্ন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলেও অভিমত তাদের।
এই খাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বেসিসের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফাহিম মাশরুর বলেন, ডিজিকনের এই বিষয়টি স্বজনপ্রীতির ঘটনা।
নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যের মতো সংবেদনশীল উপাত্ত যাচাইয়ে সরকারের নিজস্ব একটি এজেন্সি থাকতে পারে।
কিন্তু সেখানে ‘পরিচয়’ এর মতো একটি স্তর বসানোই হয়েছে নিজেদের কাউকে ব্যবসার দেওয়ার জন্য, যেখান থেকে সরকারি পক্ষও লাভবান হবে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তথ্য যাচাইয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
তবে তারা শুধু তথ্য যাচাই করে, কেউ উপাত্ত ‘রিড’ বা ‘স্টোর’ করে না। কোনো তৃতীয় পক্ষ তথ্য রিড বা স্টোর করবে না। এটাই এ খাতের প্রচলিত নিয়ম বলে জানান ফাহিম মাশরুর।
সুত্র – কালবেলা