২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ১১ অক্টোবর পর্যন্ত কর্ণফুলী টানেল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার ৯৩৪টি গাড়ি চলাচল করেছে। এসব গাড়ি থেকে দৈনিক টোল আদায় হয়েছে গড়ে প্রায় ১০.৪০ লাখ টাকা।
গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন সংযোগ হিসেবে কাজে লাগানোর জন্য নির্মিত হয়েছিল কর্ণফুলী টানেল।
কিন্তু প্রত্যাশিত মাত্রায় ব্যবহার না হওয়ায় এবং চড়া রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের কারণে টানেলটি বড় লোকসান দিচ্ছে।
চালু হওয়ার প্রায় এক বছর পর বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে এই টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২০ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মূল কারণ হচ্ছে, আনোয়ারা প্রান্তে প্রত্যাশিত শিল্প উন্নয়ন এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
এ টানেল দিয়ে প্রতিদিন ২০ হাজারের বেশি গাড়ি চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা ছিল কর্তৃপক্ষের।
কিন্তু বর্তমানে টানেল দিয়ে দৈনিক গড়ে প্রায় ৪ হাজার যানবাহন চলাচল করেছে। এতে তৈরি হয়েছে বড় আর্থিক সংকট।
কর্তৃপক্ষের হিসাবমতে, ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ১১ অক্টোবর পর্যন্ত কর্ণফুলী টানেল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার ৯৩৪টি গাড়ি চলাচল করেছে।
এসব গাড়ি থেকে দৈনিক টোল আদায় হয়েছে গড়ে প্রায় ১০.৪০ লাখ টাকা।
অথচ এই টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণসহ আনুষঙ্গিক কাজে প্রতিদিন ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৩৭ দশমিক ৫০ লাখ টাকা।
প্রতিদিনের ব্যয়ের বিপরীতে টোল আদায় থেকে উঠে আসছে মাত্র ৩০ শতাংশ।
সেই হিসাবে উদ্বোধনের পর থেকে এ পর্যন্ত ব্যয়ের তুলনায় টোল আদায় থেকে ৯০ কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে। আর দৈনিক লোকসান হচ্ছে ২৬ দশমিক ৫০ লাখ টাকার বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১০ হাজার ৬৯০ কোটি টাকায় নির্মিত টানেল প্রকল্পটি কেবল উচ্চাভিলাষীই নয়, বরং অদূরদর্শিতার প্রতিফলনও।
টানেল নির্মানের পর এটি রক্ষণাবেক্ষণ করতে গিয়ে কেমন খরচ হবে, নিয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই ছিলো না সংশ্লিষ্টদের।
দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রভাব পুরোপুরি বিবেচনা না করেই শুধু ‘স্ট্যাটাস সিম্বলের’ জন্য এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
এ প্রকল্প কতটুকু বাস্তবসম্মত, সে প্রশ্ন তুলে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে টানেল পার হয়ে আমরা আনোয়ারা প্রান্তে কেন যাব, সেটিই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আনোয়ারা, বাঁশখালীসহ সাগর উপকূলে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার যে পরিল্পনা করা হচ্ছে, সেটি কত বছরের মধ্যে তার কোনো টাইম লাইন নেই।
‘এই প্রকল্প নির্মাণের আগে বিশেষজ্ঞ টিমকে একাধিকবার বলেছি, দক্ষিণ প্রান্তে কারখানা গড়ে উঠবে, তার ওপর অনুমান করে ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে টানেল নির্মাণ করে ফেলা হবে—এর কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না।’
এ প্রকল্প গ্রহণের আগে কেউ পরামর্শ দিলে বা সমালোচনা করলে, তাকে ‘উন্নয়নবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন সুভাষ চন্দ্র।
টানেল নির্মাণের আগে করা এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৫ সাল নাগাদ ২৮ হাজার ৩০৫টি ও ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৭ হাজার ৯৪৬টি যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা করা হয়েছিল।
কিন্তু ২০২৫ সালে টানেল দিয়ে ৫ হাজার গাড়িও চলাচল করবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রামের নাগরিকরা।
টানেল সাইট অফিসের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আনোয়ারায় চায়না ইকোনমিক জোনসহ ওই অঞ্চলে প্রত্যাশিত বিকাশমান শিল্পকারখানার ওপর ভিত্তি করে টানেলে দৈনিক গাড়ি চলাচলের হিসাব ধরা হয়েছিল।
‘চায়না ইকোনোমিক জোন এবং শিল্পকারখানা এখনও সেই অনুযায়ী গড়ে ওঠেনি। এগুলো যখন গড়ে উঠবে, টানেলে যান চলাচল এবং টোল আদায় বাড়বে,’ বলেন তিনি।
যমুনা সেতুর প্রসঙ্গ টেনে আবুল কালাম আজাদ বলেন, সেখানে ইন্টারনাল রোড কানেক্টিভিটি তৈরি হয়ে গাড়ি চলাচল বাড়তে কয়েক বছর সময় লেগেছিল। কর্ণফুলী টানেলেও যান চলাচল বাড়তে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে।
অনুমানের ওপর ভিত্তি করে টানেল
‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ ধারণায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত হয়েছিলে কর্ণফুলী টানেল। এ টানেল চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে পতেঙ্গা ও আনোয়ারা উপজেলাকে যুক্ত করেছে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ টানেল দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলের মতো ‘লোকাল ট্রাফিক’ পারাপার হতে দেওয়া হচ্ছে না।
আবার টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে এখনও তেমন কোনো শিল্পকারখানাই হয়নি। ফলে যান চলাচল বাড়ছে না।
এছাড়া পরিকল্পনাধীন বে টার্মিনালও নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল পুরোপুরি চালু হয়নি।
যতদিন এসব অবকাঠামো না হবে, ততদিনে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প থেকে কোনো সুফল পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
২০১৪ সালে জাপান ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে দ্য বে অভ বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রায়াল গ্রোথ বেল্ট (বিগ-বি) ধারণার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
বিগ-বির আলোকে এ অঞ্চলে গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি হাব, উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা ও শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
কক্সাবাজার জেলা ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী ফেনীর সোনাগাজী, চট্টগ্রামের মিরসরাই-সীতাকুণ্ডের সমুদ্রপাড়ে ৩০ হাজার একর জায়গায় নির্মিত হচ্ছে বৃহৎ শিল্পনগর।
তবে নানা সংকটে এ প্রকল্পে এখনও পর্যন্ত মাত্র ১০টির মতো কারখানা উৎপাদনে যেতে পেরেছে।
বাঁশখালীর গন্ডামারা এলাকায় স্থাপিত হয়েছে এস আলম গ্রুপ ও চীনের সেপকো থ্রির যৌথ মালিকানাধীন ১,৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
আনোয়ারায় ৭৭৮ একর এলাকাজুড়ে চাইনিজ ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন (সিইআইজেড) নির্মাণ এখনও প্রক্রিয়াধীন। তবে উপকূলবর্তী এলাকায় শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে না।
এমন পরিস্থিতিতে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে টানেল নির্মাণ করা মোটেও উচিত হয়নি বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, এই টানেলের ব্যয় দিয়ে অন্তত ১০টি সেতু নির্মাণ করা যেত।
তিনি বলেন, ‘মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে টাকা লুটপাটের জন্য। প্রকল্প নেওয়ার আগে এসব বিষয় বিবেচনায় আনা হয়নি। এখন প্রতিদিন যে লোকসান হচ্ছে, এর দায়ভার কে নেবে?
‘টানেল নির্মাণ করে জনগণের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। এই টানেল এখন বিষফোঁড়া হয়ে ফাঁড়িয়েছে।’
টোলহার অনেক বেশি
সেতু বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, কর্ণফুলী টানেল অতিক্রম করতে যানবাহনের ধরনভেদে ২০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত টোল দিতে হয়।
‘টানেল নির্মাণ কতটা দূরদর্শী সিদ্ধান্ত’ শিরোনামে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক টানেল প্রকল্পটিকে অদূরদর্শী পরিকল্পনা হিসেবে অভিহিত করেছেন।
এ গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, কর্ণফুলী টানেলের ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে শাহ আমানত সেতু।
এ সেতুর তুলনায় কর্ণফুলী টানেলের টোলহার যানবাহন ভেদে আড়াই থেকে ৬ গুণ পর্যন্ত বেশি। টোল হারের এ পার্থক্য টানেলে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর, সিইপিজেড, কেইপিজেড, নির্মাণাধীন বে-টার্মিনাল ও বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর, চট্টগ্রাম মহানগরের অধিকাংশ অঞ্চল, চট্টগ্রাম জেলার উত্তর অংশ এবং রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যানবাহন চলাচলে এই টানেল ব্যবহার হওয়ার কথা ছিল।
আবার অপরপ্রান্তে, অর্থাৎ আনোয়ারা প্রান্তের টানেল মুখসংলগ্ন সিইউএফএল, কাফকো, কেইপিজেড, চায়না ইপিজেড, পারকি বিচ, কক্সবাজার জেলার মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি টার্মিনাল, কক্সবাজার-টেকনাফ-সেন্টমার্টিনের পর্যটকসহ পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল করার কথা ছিল।
তবে সরেজমিনে দেখা যায়, এ টানেল দিয়ে যাতায়াত করা যানবাহনের বেশিরভাগই কার, মাইক্রোবাস ও ট্যুরিস্ট বাস।
অর্থাৎ ঢাকা কিংবা সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দক্ষিণ চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাণিজ্যিক যানবাহন ও ভারী পণ্যবাহী যানবাহনের পরিবর্তে টানেল দেখতে যাওয়া দর্শনার্থীর যানবাহনই টানেলে প্রবেশ করেছে সবচেয়ে বেশি।
সুত্র – টিবিএস