গণতন্ত্রের মুখোশে একনায়কের উত্থান হয় কেন?

নাভিদ সালেহ

সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের কথা আমরা জানি। পাণ্ডবদের ভেতর জ্যেষ্ঠ এই যম-তনয় ছিলেন সত্য ও ন্যায়বিচারের ধারক।

শকুনির আয়োজনে পাশা খেলতে এসে যখন সব কিছু পণ রাখেন যুধিষ্ঠির, এমনকি শেষদানে দ্রৌপদিকে পর্যন্ত, তখন তাঁর সততার দায় দ্রৌপদিকে বস্ত্রহরণের অপমানের দিকে ঠেলে দেয়।

দুর্যোধনের কাছে যুধিষ্ঠিরের পরাজয়ের এই মহাভারতীয় গল্প যেমন একদিকে সত্য ভাষণের কথা বলে, অন্যদিকে এটি উপমহাদেশের পুরাণ ও এর মনস্তত্ত্বের কেন্দ্রে যে ইনফ্যালিবিলিটি বা ভ্রমশূন্যতা বিরাজ করে, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।

আমাদের সংস্কৃতি, মননে আত্মসমালোচনা বা আত্মপরিশুদ্ধি ঢোকানোর কোনো জায়গা নেই। আমরা যা জানি তা ভুল হতে পারে না।

আর যা জানি না তা জানাটা যেন জরুরি নয়। আমাদের নেতারাও তেমনি আচরণ করেন। তারা যা বিশ্বাস করেন, তা-ই সত্য, সর্বোত্তম।

জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালো-মন্দ তারাই কেবল অনুধাবন করতে পারেন।

নেতা বা নেত্রী একাই সব ব্যক্তির মনের খবর জানেন। যেন জনগণ একটি সমষ্টি, সিঙ্গুলার। তাদের হয়ে যে সিদ্ধান্তই নেতৃত্ব নিক না কেন, তা-ই সঠিক।

আর জনগণের যে অংশ এই সমষ্টি-চিন্তার বাইরে, তারা যেন দেশের নাগরিকই নন; তারা দেশদ্রোহী।

এ জন্যই আমাদের এই অঞ্চলে গণতন্ত্রের মুখোশে একনায়কের উত্থান হয়। দ্বিমতের কোনো জায়গাই যেন নেই আমাদের সমাজে। আমি সঠিক, আপনি বেঠিক।

আমার দল উত্তম, আপনারটি ষড়যন্ত্রকারী। আমার সংস্কৃতি উন্নত, আপনারটি আদিম। আমার ধর্ম নির্ভুল, আপনারটি হয় অধর্ম বা নিদেনপক্ষে হীনতর।

এই সবজান্তার ভিড়ে, সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরদের সমাজে সমালোচনা বা পরিশোধনের কোনো অবকাশই নেই।

বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটেছে। মানুষ ব্যক্তি হিসেবে ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রকাশ করতে পারছে।

তবে সরকার উৎখাতের শেষে সাধারণ মানুষের ভেতর নির্মমতা, জিঘাংসা আর বিভাজনের তীব্রতা যেন বাড়তে দেখা যাচ্ছে। একে দেখে নেব, তাকে চিনে রাখছি– এই এখন সংকল্প।

একনায়কের দোসর গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমরা উল্লসিত হতে পারি; আদালতে হাজিরার সময় তার ওপর হামলা করব কেন? বহিরাগতকে চুরির দায়ে যাচাই-বাছাই ছাড়া পিটিয়ে মেরে ফেলা কি সুবিচার?

আদিবাসীদের বাড়িঘর পুড়িয়ে, সংখ্যালঘুদের মন্দির ভেঙে, মাজারে হামলা করে আমরা কোন ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে চলেছি? একনায়কতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আমরা কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ আসলেই ধরতে পারছি?

আদি সমাজে কোনো রাষ্ট্রযন্ত্র ছিল না। মানুষ ছোট ছোট গোত্রে বিভক্ত হয়ে যাযাবর জীবন কাটাত। কোনো ইজম বা তন্ত্রকে ব্যবহার করে শোষণের কোনো প্রক্রিয়াই বিরাজমান ছিল না।

নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে একদিকে ধর্ম, অন্যদিকে ইজমকে ব্যবহার করা যখন থেকে শুরু হলো, তখন প্রজারা, শোষিতরা, প্রলেতারিয়েতরা শোষণের বিরোধিতার মধ্যে ন্যায়কে, সত্যকে আবিষ্কার করতে শুরু করল। আমার শোষক যা বলবে তা-ই নিষ্পেষণের মন্ত্রণা।

আমরা দ্বিমতের মধ্য দিয়েই কেবল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারব। নিটশে তাঁর ‘অন জিনিওলজি অব মোরালস’ গ্রন্থে বলছেন, প্রতিবাদ থেকে, রিসেন্টমেন্ট বা আক্ষেপ থেকে যে মোরাল বা নীতির জন্ম হয় তা দুর্বল সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে ঠেলে দেয় আমাদের।

অর্থাৎ আমার নীতি নিষ্পেষণ ঠেকানোর প্রচেষ্টা থেকে জাত। এই নীতির ভিত্তি স্বাধীনতা, মুক্তি বা সত্যের শক্তি নয়। এই শক্তির ভিত্তি তৈরি করতে পারে প্রকৃত সত্যানুসন্ধান।

আমি যখন মেনে নেব– আমি ভুল হতে পারি, আমি যা জানি তা বেঠিক হতে পারে, তখনই সত্যকে জানার আর ভুল শোধরানোর সুযোগ তৈরি করতে সক্ষম হই।

ইউভাল হারারি তাঁর নব্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘নেক্সাস’-এ বলছেন, একটি সমাজ যখন ভ্রমশূন্যতার জায়গায় আত্মপরিশুদ্ধিকে প্রাধান্য দেবে তখনই সে সমাজে ন্যায়বিচার দীর্ঘস্থায়ী হবে।

এ কারণেই আমাদের সমাজে বিজ্ঞানমনস্কতার বিস্তার দরকার। এর মানে সবাই বিজ্ঞানী হয়ে যাওয়া নয়, বরং জাতি হিসেবে এটি মেনে নেওয়া যে, তথ্য-উপাত্ত যদি আমার জ্ঞানকে ভুল প্রমাণ করে; আমার ধারণাকে অসম্পূর্ণ প্রতীয়মান করে; আমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কথা বলে; তবে আমি আত্মশুদ্ধির কথা বিবেচনা করব।

অর্থাৎ যাচাইকৃত উপাত্তের ভিত্তিতে নিজের মত বদলাতে প্রস্তুত থাকব।

সমাজের প্রতিটি স্তরে এই চর্চা যদি নিয়ে আসা যায় তবে পরমতসহিষ্ণুতা, অপরকে নিজের সমান বলে ধরে নিয়ে, তার ধারণা বা বিশ্বাসকে সম্মান দিতে আমরা শিখব।

তখন আমরা দ্রোহ আর প্রতিবাদ থেকে নির্মম আচরণকে বিচার হিসেবে ধরে না নিয়ে শক্তির জায়গা থেকে, জ্ঞানের জায়গা থেকে সুবিচার প্রতিষ্ঠার দিকে এগোব।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা কাজী নজরুল যেমন বাঙালির কাছে জরুরি, তেমনি অনন্ত কুমার সেরাম মণিপুরিদের কাছে, কল্পনা চাকমা বা ত্রিদিব রায় চাকমা সম্প্রদায়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

কোরআন যেমন আমার কাছে পবিত্র, তেমনি বেদ, বাইবেল, তালমুদ, ত্রিপিটক বা আদিবাসী কোনো ধর্মগ্রন্থ আমার প্রতিবেশীর কাছে সমানভাবে অলঙ্ঘনীয়।

সামাজিক চর্চায় যদি আমরা এই সমান্তরাল ধারণা, বিশ্বাসকে মর্যাদা দিয়ে, সেলফ-কারেকশনের মন্ত্রণা নিতে পারি, তবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে হয়তো আর একনায়কের খড়্গ-কৃপাণ ক্ষমতার দৌরাত্ম্যে পুরো সমাজকে অবরুদ্ধ করতে পারবে না।

নাভিদ সালেহ: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিনে পুরকৌশল, স্থাপত্য ও পরিবেশ কৌশল অনুষদের অধ্যাপক । (সমকালে প্রকাশিত)

মতামত দিন