প্রকৃতি সংরক্ষণে বেশ পিছিয়ে বাংলাদেশ। এ–সংক্রান্ত বৈশ্বিক সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে এ দেশের অবস্থান ১৭৩তম।
তালিকায় শীর্ষে রয়েছে লুক্সেমবার্গ। এরপর যথাক্রমে এস্তোনিয়া ও ডেনমার্ক। সর্বশেষ অবস্থানে রয়েছে কিরিবাতি।
নিজ নিজ দেশে প্রকৃতি রক্ষায় রাষ্ট্রগুলো কতটুকু ভূমিকা রাখছে তার ভিত্তিতে এ সূচক তৈরি করা হয়েছে।
প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা বায়ো ডিবি তৈরি করেছে সূচকটি।
মূলত প্রকৃতি রক্ষায় গত এক যুগে দেশগুলোর নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ মূল্যায়নের ভিত্তিতে সূচকটি তৈরি করা হয়েছে।
জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্যবিষয়ক সম্মেলন ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস টু দ্য কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি’ (সিবিডি কপ ১৬) উপলক্ষে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
কলম্বিয়ার ক্যালি শহরে ২১ অক্টোবর সম্মেলনটি শুরু হয়েছে, যা ১ নভেম্বর শেষ হবে।
২০২৪ সালের এ তালিকায় বাংলাদেশের চেয়ে তিন ধাপ নিচে রয়েছে ভারত। দেশটির অবস্থান ১৭৬তম।
তবে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে কয়েকটি দেশ। সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ১০০–এর মধ্যে ৪৬ দশমিক ১৪।
এগিয়ে থাকা এসব দেশের মধ্যে নেপাল আছে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে (৬০তম)। এর র শ্রীলঙ্কা আছে ৯০তম, মালদ্বীপ ১৫০, পাকিস্তান ১৫১ ও আফগানিস্তান ১৬০তম অবস্থানে।
তালিকায় বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে ভারত (১৭৬তম)। বাংলাদেশের আগে রয়েছে আফগানিস্তান (১৬০তম), পাকিস্তান (১৫১), মালদ্বীপ (১৫০), শ্রীলঙ্কা (৯০) ও নেপাল (৬০)।
প্রতিবেদনটি সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গনমাধ্যমকে বলেন, ‘খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমরা পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। সবার সহযোগিতা পেলে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের পরিবেশ ও প্রকৃতি সুরক্ষায় নিজস্ব সূচক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। ওই সূচকের ভিত্তিতে আমরা আমাদের কাজের অগ্রগতিগুলো বিবেচনা করব।’
সূচক তৈরিতে ৫ নির্দেশক
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক বৈশ্বিক সূচকটি তৈরিতে পাঁচটি নির্দেশক ব্যবহার করা হয়েছে।
এগুলো হলো, প্রকৃতি সংরক্ষণে রাষ্ট্রের ভূমি ব্যবস্থাপনা, জীববৈচিত্র্যের ওপর হুমকি, সক্ষমতা, সুশাসন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। সূচক নির্ধারণে ব্যবহার করা হয়েছে একেকটি রাষ্ট্রের সরকারি উৎসের তথ্য।
ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো হলো, ভূমি ও সাগরের সংরক্ষিত এলাকার পরিমাণ; সংরক্ষিত এলাকাগুলো একটির সঙ্গে অন্যটি কতটা যুক্ত; শহর, শিল্প ও কৃষিজমির পরিমাণ কত দ্রুত বাড়ছে এবং কৃষিতে কী পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশ যে বিষয়গুলোতে ভালো অবস্থানে আছে, সেগুলোতেও নানা ধরনের সমস্যা আছে। বিগত দিনগুলোতে বাংলাদেশের প্রকৃতি সংরক্ষণে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে, যত আইন তৈরি হয়েছে ও আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে, তা কতটুকু কার্যকর হয়েছে, সে মূল্যায়ন আমাদের এখানে কম করা হয়েছে। —ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ, আইইউসিএন, বাংলাদেশের সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর
জীববৈচিত্র্যের ওপর হুমকির ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো, দেশের মোট বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে কতটি লাল তালিকা বা নানাভাবে হুমকিতে রয়েছে সেটি।
তালিকা তৈরিতে এগুলোর সংখ্যা ও পরিমাণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আছে, সংরক্ষিত এলাকায় কত প্রাণীর বসবাস ও আগ্রাসী প্রজাতির প্রাণীর উপস্থিতির বিষয়টি।
সূচকের অন্য নির্দেশকগুলোর মধ্যে আছে, একটি দেশে জিডিপির (মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন) কত শতাংশ প্রকৃতি সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়, প্রকৃতি সংরক্ষণে কতটি সংস্থা ও আইন আছে, আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য সনদের শর্তগুলো কতটা বাস্তবায়ন করা হয়; রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, সরকারের কার্যক্ষমতা এবং গণতান্ত্রিক অবস্থা।
কয়েকটি ক্ষেত্রে এগিয়ে বাংলাদেশ
সূচকে কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শীর্ষ অবস্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, প্রতিবেশ ব্যবস্থার প্রতিটি কোনো না কোনোভাবে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা।
যেমন পাহাড়, সমতল, নদী, সমুদ্র, ম্যানগ্রোভের মতো বিশেষ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এলাকা সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করা।
জীববৈচিত্র্যবিষয়ক জাতিসংঘ সনদ সিবিডি এবং বন্য প্রাণী পাচার রোধবিষয়ক সনদ সাইটসে স্বাক্ষর করা। মোট জিডিপি থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ প্রকৃতি সংরক্ষণে ব্যবহার করা।
এ ব্যাপারে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট–আইইউসিএন, বাংলাদেশের সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ গনমাধ্যমকে বলেন, ‘বাংলাদেশ যে বিষয়গুলোতে ভালো অবস্থানে আছে, সেগুলোতেও নানা ধরনের সমস্যা আছে। বিগত দিনগুলোতে বাংলাদেশের প্রকৃতি সংরক্ষণে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে, যত আইন তৈরি হয়েছে ও আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে—তা কতটুকু কার্যকর হয়েছে, সে মূল্যায়ন আমাদের এখানে কম করা হয়েছে।
এদিকে কয়েকটি নেতিবাচক বিষয়ে বাংলাদেশ তালিকায় শেষের দিকে থাকা দেশগুলোর কাতারে আছে। যেমন ভিন্ন ধরনের জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ এলাকার মধ্যে আন্তঃসংযোগ কম থাকা।
এমন দেশের তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৮তম। জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা থেকে পরিবর্তিত হয়ে কৃষি বা অন্য খাতে ব্যবহৃত হওয়া জমির পরিমাণের দিক থেকে বাংলাদেশ ১৭৯তম অবস্থানে। এসব জমিতে আগে যেসব প্রাণী বসবাস করত, সেসবের বড় অংশ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আগামী দিনে বাংলাদেশে প্রকৃতি রক্ষায় তদারকি ও মূল্যায়নকে গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের পরিস্থিতি দেখলে মনে হয়, বন রক্ষার দায়িত্ব শুধু বন বিভাগের।
অন্য সরকারি সংস্থাগুলো যদি রাস্তা নির্মাণ, বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া ও অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে বন রক্ষাকে গুরুত্ব দেয়, তবে দেশের প্রকৃতি আরও বেশি রক্ষা পাবে, আমরা সূচকে এগিয়ে যাব।’
সুত্র- প্রথম আলো