যশোরে ৩০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে ‘শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক’।
আওয়ামী লীগ সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছিলেন, এটি হবে ‘বাংলাদেশের সিলিকন ভ্যালি’।
কিন্তু ২০১৭ সালে চালুর পর এটি দেশের প্রযুক্তি খাতে তেমন অবদান রাখতে পারেনি; বরং পরিচালনার খরচ তুলতে এখানে আয়োজন করা হয় চাকরি মেলা ও বিয়ে-বউভাতের মতো অনুষ্ঠান। খবর সমকাল
স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা এখানে চালু করেছেন তিন তারকা মানের ‘হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট’।
সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, পলকের ‘সিলিকন ভ্যালি’ আসলে ছিল ফাঁপা বুলি। হাই-টেক ও সফটওয়্যার পার্কগুলো এখন ভবনসর্বস্ব।
দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিকাশ এবং বিদেশি বিনিয়োগের কথা বলে শেখ হাসিনার সরকার গত ১৫ বছরে ৯২টি হাই-টেক ও সফটওয়্যার পার্ক এবং ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয়।
এতে মোট খরচ ধরা হয় ৮ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা।
এর মধ্যে তিনটি হাই-টেক পার্ক, তিনটি সফটওয়্যার পার্ক এবং চারটি ইনকিউবেশন সেন্টার চালু হয়েছে।
এই ১০টিতে মোট স্পেস রয়েছে ১০ লাখ ২৬ হাজার বর্গফুট। এর মধ্যে ৬ লাখ ৬০ হাজার বর্গফুট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে (খালি ৪০ শতাংশ জায়গা)।
তবে যে উদ্দেশ্যে বিপুল ব্যয়ে এসব পার্ক ও সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে, তা পূরণ হচ্ছে না।
এসবে বিনিয়োগ হয়েছে নামমাত্র। ইনকিউবেশন সেন্টারগুলো কার্যত অচল। উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠান পার্ক ছেড়ে চলে গেছে। বরাদ্দ নিয়েও কার্যক্রম শুরু করেননি কেউ কেউ।
পার্কে চালু প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কলসেন্টার ও ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানা বেশি। প্রতিষ্ঠানগুলো ধুঁকছে দক্ষ জনবল সংকটে।
আরও পড়ুন
- হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়, তবু ডিজিটাল সূচকে পিছিয়ে বাংলাদেশ!
- লুটপাটে কোমায় টেলিটক! ফিরবে কি প্রাণ?
আওয়ামী লীগ সরকার জানিয়েছিল, হাই-টেক পার্কগুলো পুরোদমে চালু হলে ২০২৫ সালের মধ্যে ৫২ হাজার এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ২ লাখ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
তবে চালু পার্কগুলোতে এখন পর্যন্ত মাত্র ২ থেকে ৩ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
খাত-সংশ্লিষ্টদের মতে, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও জরিপ ছাড়াই পার্কগুলো করা হয়েছে। যেসব স্থানে হাই-টেক ও সফটওয়্যার পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে, সেখানে ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠেনি। ফলে দক্ষ কর্মী মিলছে না।
তারা বলছেন, সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু ভবন তৈরি না করে যদি একটি স্থানে প্রযুক্তি হাব গড়ে তোলা যেত, সেটি হতো বাংলাদেশের সিলিকন ভ্যালি। বিনিয়োগের সুফলও পাওয়া যেত।
উল্লেখ্য, সিলিকন ভ্যালি হলো, যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার ৩০০ বর্গমাইল একটি এলাকা।
সানফ্রান্সিসকো ও স্যান হোসে শহরের মাঝামাঝি এই সিলিকন ভ্যালি ১৯৯৫ সালের পর তথ্যপ্রযুক্তির বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।
এই ভ্যালিতে জন্ম নিয়েছে ইয়াহু, গুগল ও ইবের মতো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এখানে প্রায় ৪ হাজার প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বছরে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করে।
চালু পার্ক ও ইনকিউবেশন
আওয়ামী লীগ সরকার গাজীপুরের কালিয়াকৈরে চালু করেছে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি।
এ ছাড়া যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ভিশন টাওয়ার সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, রাজশাহীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাই-টেক পার্ক ও শেখ কামাল আইটি ইনকিউবেশন সেন্টার, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্ক, চট্টগ্রামে শেখ জামাল সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক এবং নাটোরে, বরিশালে, চুয়েট ও কুয়েটে চালু হয়েছে আইটি ইনকিউবেশন।
হাই-টেক পার্কগুলোতে প্রায় ২০০ প্রতিষ্ঠানকে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে– চীনের অরিক্স, দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই, স্যামসাং, জাপানের সনি, যুক্তরাষ্ট্রের ডেটা ও আইটি বিজনেস সেন্টার, ভারতের হিরানান্দানি গ্রুপ ইত্যাদি।
দেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে– ওয়ালটন, ফেয়ার গ্রুপ, প্রাণ-আরএফএল, র্যাংগস প্রভৃতি।
প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরি করছে।
এর মধ্যে রয়েছে– মোটরসাইকেল, গাড়ি, রেফ্রিজারেটর ও মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশ। সফটওয়্যার কোম্পানির সংখ্যা হাই-টেক পার্কে খুবই কম।
প্রযুক্তি উদ্যোক্তা রাসেল টি আহমেদ বলেন, ‘সমীক্ষা ছাড়াই হাই-টেক ও টেকনোলজি পার্কগুলো গড়ে তোলা হচ্ছে। এগুলোর পরিকল্পনা, নির্মাণ ও বাস্তবায়নে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের কোনো সহযোগিতা নেওয়া হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘যেসব স্থানে পার্ক হচ্ছে বা হয়েছে, সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠেনি।
ফলে একজন আইটি প্রকৌশলী ঢাকায় যে পরিবেশ পাচ্ছেন, তা যশোর বা রাজশাহী বা সিলেটের হাই-টেক পার্কে পান না।
তাই তিনি সেখানে যেতে চান না।’ তাঁর মতে, দেশজুড়ে হাই-টেক পার্ক না বানিয়ে সিলিকন ভ্যালির মতো একটি এলাকাকে যদি তথ্যপ্রযুক্তির হাব হিসেবে গড়ে তোলা হতো, তবে দেশের আইটি খাত এগিয়ে যেত।
ছেড়ে যাচ্ছেন অনেকে, পড়ে আছে প্লট
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাই-টেক পার্ক নির্মাণ হয় ৩১৯ কোটি টাকায়। ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর এটি উদ্বোধন হয়।
১৬৩ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত পার্কে ২১টি প্রতিষ্ঠান জমি বরাদ্দ নিলেও সময়মতো কাজ শুরু না করায় চারটির বরাদ্দ বাতিল হয়। পার্ক ছেড়ে চলে যায় আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
বর্তমানে এখানে রয়েছে ১১টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে অধিকাংশই নিজের অবকাঠামো তৈরি করতে পারেনি।
ছেড়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানের মালিকরা জানান, ঋণ সুবিধা না থাকা এবং বিনিয়োগ উঠে আসা নিয়ে সংশয়সহ বিভিন্ন কারণে তারা পার্কের প্রতি আগ্রহ হারিয়েছেন।
এমনকি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারাও এই পার্ক ছেড়ে চলে গেছেন।
যেমন এখানে প্লট ছেড়ে দেওয়া আরটিএন টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির কর্ণধার ড. আহমদ আল কবির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের আত্মীয় ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য।
চলে যাওয়া আরেক প্রতিষ্ঠান নুহ অ্যান্ড সোহান এন্টারপ্রাইজের মালিক কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা শামীম আহমদ।
যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে তালিকাভুক্ত ৫৪টি কোম্পানির মধ্যে কাজ করছে ৪২টি। এর মধ্যে পাঁচ থেকে সাতটি কলসেন্টার, দু-তিনটি ই-কমার্স, চারটি আইএসপি ও তিনটি গ্রাফিক্স ডিজাইন-সংক্রান্ত সেবা প্রদান করে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো সফটওয়্যার তৈরির কাজ করে।
পার্কে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন ৬০০ কর্মী। এর মধ্যে ই-কমার্স ও কলসেন্টার কর্মীই বেশি।
ফলে আইটি খাতের দক্ষ জনশক্তি এখানে তৈরি হচ্ছে না। এই পার্কে কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্য ছিল ২ হাজার জনের।
বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, এখানে জমি বরাদ্দে নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। ২০১৮ সাল থেকে সফটওয়্যার ও অ্যানিমেশন নিয়ে কাজ করা একটি প্রতিষ্ঠান ২০২২ সালে এই পার্ক ছেড়ে দেয়।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মেহেদী হাসান শোভন বলেন, ‘পার্কের চেয়ে অনেক কম খরচে যশোর শহরে ব্যবসা করা যায়।
আইটি পার্কটি টিকে আছে বিভিন্ন কলসেন্টারের ওপর। সেখানে দু-একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউ সফটওয়্যার তৈরির কাজ করে না।’
ফ্রিডম ফাইটার আইটির ডিজিএম মিকাইল হোসেন জানান, এই পার্কে দেড় বছর কাজ করার পর তাঁকে ঢাকায় যেতে হয়েছে। কারণ, পরিবেশের জন্য পার্কে ভালো ডেভেলপার যেতে চান না।
রাজশাহী হাই-টেক পার্ক নির্মাণ খরচ দুই দফায় বেড়ে ২৩৮ কোটি টাকা থেকে ৩৩৫ কোটি হয়েছে।
এখানে জয় সিলিকন টাওয়ারে ছয়টি কোম্পানি জমি বরাদ্দ পেয়েছে। কাজ শুরু করেছে তিনটি।
এর একটি হলো বিজনেস অটোমেশন। প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুবায়েদ জামান জানান, হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ এখনও জায়গা পুরোপুরি হস্তান্তর করেনি।
কাজ শুরু করা অন্য দুটি প্রতিষ্ঠান হলো– নেত্ররো ও স্টারটেক। অপর তিন প্রতিষ্ঠান এটিসি, ইনফোটেক ও এসটিজিডি এখনও কাজ শুরু করতে পারেনি।
পার্কে শেখ কামাল ট্রেনিং সেন্টারে জায়গা পেয়েছে ছয়টি কোম্পানি। সব মিলিয়ে এই পার্কে কাজ করছেন ৩০০ জন। এখানে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ এবং সফটওয়্যার ও গেমস তৈরি হচ্ছে।
গাজীপুরের কালিয়াকৈর বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্কে ৭০টি প্লট বিভিন্ন কোম্পানিকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কাজ করছে ৩৪টি।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্মাণকাজ শুরু না করায় ৯টি কোম্পানির বরাদ্দ বাতিল হয়েছে।
পার্কে চালু প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে– গাড়ি নির্মাতা হুন্দাই, নকিয়া মোবাইল, অপটিক্যাল ফাইবার কোম্পানি লিও আইসিটি কেবল। পার্কে ৯১ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সামিট গ্রুপকে।
চট্টগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. শেখ জামাল সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয়।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর মার্কেটের ওপর এটি তৈরি করা হয়েছে।
১৪টি প্রতিষ্ঠানকে স্পেস বরাদ্দ দিলেও এখন পর্যন্ত কেউ এখানে বিনিয়োগ করেননি।
৮৯ হাজার বর্গফুট আয়তনের এই পার্কে পড়ে আছে ৮৩ হাজার বর্গফুট স্পেস। বিপুল কর্মসংস্থানের কথা বলা হলেও তা হয়নি। সিঙ্গাপুর মার্কেটের ৬ থেকে ১১ তলায় এর অবস্থান।
কাজে আসছে না ইনকিউবেশন সেন্টার
নাটোর শহরের কান্দিভিটা এলাকার পুরোনো জেলখানা মেরামত করে গড়ে তোলা হয়েছে শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ইনকিউবেশন সেন্টার। এখানে সাতটি প্রতিষ্ঠানকে জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়, যার তিনটি জনবল প্রশিক্ষণ দেয়।
এই ইনকিউবেশন সেন্টারে ২০১৮ সালে প্রশিক্ষণ নেন রেশমা আক্তার সেতু।
কিন্তু প্রশিক্ষণটি তাঁর কাজে লাগেনি। পরে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন তিনি সফল। শহরের আলাইপুর এলাকার অসীম কুমার দাস বলেন, ‘ছয় মাস প্রশিক্ষণ নিয়েও তা কাজে লাগেনি।
এর মধ্যে তিন মাস ছিল ইংলিশ কোর্স ও তিন মাস ওয়েব ডিজাইন।
’ চকবৈদ্যনাথের হান্নান, নলডাঙ্গার সাকিবুর রহমান, রাজাপুর কামারদিয়ার গ্রামের শাহিন আলমসহ বেশ কয়েকজন জানান, ছয় মাস প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর তারাও বেকার।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) পাশে শেখ কামাল আইটি ইনকিউবেশন অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারেও সাড়া কম।
বলা হয়েছিল, চালু হলে বছরে প্রায় ৫০০ আইটি স্টার্টআপ এখানে যুক্ত হবে। কিন্তু সেন্টারটি চালুর পর স্টার্টআপ হিসেবে যুক্ত হয়েছেন মাত্র ৪০ জন। তাদের বেশির ভাগ আবার মাঝপথে থেমে গেছেন।