শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো সনদ নেই, তবে তাঁর আছে ধান নিয়ে নতুন নতুন উদ্ভাবনের কৃতিত্ব।
সংকরায়ণের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করছেন তিনি।
স্বশিক্ষিত এই বিজ্ঞানীর কাজ আমলে নিয়েছে খোদ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরাও।
এসব জাত এখন স্বীকৃতির অপেক্ষায় আছে। নূর মোহাম্মদ নামের এই ব্যক্তি এবার মালয়েশিয়ায় কৃষক-বিজ্ঞানী সম্মেলনে ডাক পেয়েছেন।
এ উদ্দেশে তিনি গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে মালয়েশিয়া রওনা হন।
মালয়েশিয়ার পেনাং শহরে এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে পেস্টিসাইড অ্যাকশন নেটওয়ার্ক এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক (প্যানাপ)।
স্থানীয় একটি হোটেলে ৬ থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে এ সম্মেলন।
১০ নভেম্বর পর্যন্ত নূর মোহাম্মদ সেখানে থাকবেন। ওই সম্মেলনে যেতে সহযোগিতা করেছে গবেষণা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস নলেজ (বারসিক)।
নূর মোহাম্মদের বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার গোল্লাপাড়া গ্রামে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন।
বরেন্দ্রভূমির ওই অঞ্চলে প্রায় প্রতিবছরই খরার কবলে পড়ে ধান নষ্ট হয়ে যায়।
সেই ধান রক্ষা করতেই উঠেপড়ে লাগেন নূর মোহাম্মদ। একপর্যায়ে নিজের মাটির ঘরটাকে বানিয়ে ফেলেন গবেষণাগার।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান হেলাল উদ্দিনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সেখানে হাতে-কলমে শিখেন অনেক কিছু।
নূর মোহাম্মদের দাবি, এ পর্যন্ত সংকরায়ণের পর তাঁর কৌলিক সারির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০০।
সর্বশেষ তিনি একটি নতুন সারি উদ্ভাবন করেছেন। দেশে প্রচলিত বোরো ধান বপনের শুরু থেকে কাটা পর্যন্ত ১৪০ দিন লাগলেও তাঁর উদ্ভাবিত এ ধান বোরো মৌসুমে বপন থেকে ১৩০ দিনের মধ্যে কাটা যাবে।
তিনি খরাসহিষ্ণু ধানটির সারির নাম দিয়েছিলেন এনএমকেপি-৫। এনএমকেপির অর্থ হচ্ছে ‘নূর মোহাম্মদ কৃষি পরিষেবা’।
প্রথম দিকে তিনি এনএমটি অর্থাৎ নূর মোহাম্মদ তানোর নামের ধানের নামকরণ করতেন।
নূর মোহাম্মদ বলেন, এনএমকেপি-৫-এর বিঘাপ্রতি ফলন ২৫ মণ। এ ধানের বিশেষত্ব হচ্ছে—পাকার পরও পাতা সবুজ থাকে। সেই সঙ্গে গাছ মজবুত, খরাসহিষ্ণু ও পোকামাকড় ও রোগবালাই অনেক কম।
এটি রোপা আমন মৌসুমেও হয়। তখন জীবনকাল হয় ১১০ থেকে ১১৫ দিন।
এ ধান বোরো মৌসুমে ২৫ মণ ও আমন মৌসুমে ১৮ মণ পর্যন্ত হয়।
এ জাতের ধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুরুর আগেই ঘরে তোলা যাবে। সাধারণত শেষের দিকে সেচের খরচ বেড়ে যায়। পাম্পেও পানি কম মেলে। প্রথম দিকের চেয়ে পানির পরিমাণও বেশি লাগে।
১০ দিন আগে ওঠার কারণে সেচের খরচ কম হবে। আগাম ওঠার কারণে ভালো বাজার মিলবে। চাল চিকন। ভাত খেতে ভালো।
নূর মোহাম্মদের মতে, তাঁর পাঁচটি জাত স্বীকৃতি পাওয়ার মতো। এগুলো হচ্ছে এনএমকেপি-১ থেকে এনএমকেপি-৫ পর্যন্ত।
তিনি দেশের প্রচলিত ধানের জাতকে উজ্জীবিত করে এটির জীবনকাল কমিয়ে এনেছেন। কোনোটির ফলন বাড়িয়েছেন। খরাসহিষ্ণু জাতের উদ্ভাবন করেছেন।
এ ছাড়া আমন মৌসুমের জন্যও তিনি খরাসহিষ্ণু ও স্বল্প জীবনকালের আরও দুই জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন। এর একটির নাম দিয়েছেন এনএমকেপি-৫ ও অন্যটির নাম দিয়েছেন এনএমকেপি-১০১।
নূর মোহাম্মদ সবচেয়ে স্বল্প জীবনকালের খরাসহিষ্ণু বোরো ধান উদ্ভাবন করেছেন বলে দাবি করেছেন। এই ধানের নাম দিয়েছেন এনএমকেপি-১০৩।
সুগন্ধি এ ধান আমন মৌসুমেও হয়। কৃষি উৎপাদনে সাফল্যের জন্য নূর মোহাম্মদ ২০০৫ সালে রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন।
২০১৮ সালে সেরা কৃষি উদ্ভাবন ক্যাটাগরিতে তীর-প্রথম আলো কৃষি পুরস্কার পেয়েছেন এই ‘বিজ্ঞানী’।
স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী নূর মোহাম্মদের স্বল্প জীবনকালের ধান উদ্ভাবন
স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী নূর মোহাম্মদের এবারের উদ্ভাবন স্বল্প জীবনকালের সরু ধান।
এ জন্য সেচও কম লাগে। ঝড়–বাদলের মৌসুম শুরুর আগেই কৃষক এই ধান কেটে ঘরে তুলতে পারবেন।
১৩০ দিনের জীবনকাল এই ধানের গাছ খাটো। ঝড়ে ঢলে পড়ে না। বোঁটা শক্ত, বাতাসে ধান ঝরে পড়ে না। ফলন ভালো। এই ধানের ভাত ঝরঝরে। খেতে ভালো।
নূর মোহাম্মদের দাবি, বাংলাদেশে বোরো মৌসুমে এত কম জীবনকালের ধান আর নেই।
এর আগে তিনিই এনএমকেপি-৫ নামের একই জীবনকালের ধান উদ্ভাবন করেছিলেন, কিন্তু সেটার চাল ছিল মোটা।
তাঁর পক্ষ থেকে দেশের কৃষকদের জন্য এবারের ঈদের উপহার হচ্ছে এই নতুন ধান।
গত শনিবার সকালে রাজশাহীর তানোরের গোল্লাপাড়ায় নূর মোহাম্মদের গবেষণা মাঠে গিয়ে দেখা যায়, আগের রাতের ঝোড়ো হাওয়ায় পাশের খেতের অন্যান্য জাতের ধান পড়ে গেছে।
তবে নূর মোহাম্মদের নতুন জাতের এই ধানগাছ খাড়া রয়েছে। একটিও হেলে পড়েনি। নূর মোহাম্মদ বলেন, এবার বিঘায় প্রায় ২৫ মণ হারে ফলন হবে।
যদি তিনি (নূর মোহাম্মদ) এটা করে থাকেন, তাহলে কৃষকের জন্য ভালো হয়। এর সঙ্গে ফলন আরও বাড়াতে হবে। চালটা চিকন হতে হবে এবং স্বাদও ভালো হতে হবে। কারণ জীবনকাল কমিয়ে আনলে ধানের ফলন কম হয়।- ফজলুল ইসলাম, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়
এ সম্পর্কে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ফজলুল ইসলাম বলেন, ‘নূর মোহাম্মদের গবেষণা মাঠে আমি বেশ কয়েকবার গিয়েছি। গবেষণা পর্যায়ের তিনি একজন ভালো কর্মী। তাঁর এবারের ধান সম্পর্কে আমি এখনো অবহিত নই। তবে ১৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশে সাধারণত বোরো মৌসুমে ধান হয় না। জীবনকাল কমিয়ে আনলে ধানের ফলন কম হয়।যদি তিনি এটা করে থাকেন, তাহলে কৃষকের জন্য ভালো হয়। এর সঙ্গে ফলন আরও বাড়াতে হবে। চালটা চিকন হতে হবে এবং স্বাদও ভালো হতে হবে।’
নূর মোহাম্মদের বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার গোল্লাপাড়া গ্রামে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন।
বরেন্দ্রভূমিতে প্রতিবছরই খরায় নষ্ট হয়ে যায় ধান। সেই ধান রক্ষা করতেই গবেষণার কাজে লেগে যান তিনি। নিজের মাটির ঘরটা হয়ে উঠেছে রীতিমতো গবেষণাগার।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান হেলাল উদ্দিনের সাহচর্য পান নূর মোহাম্মদ। সেখানে হাতে-কলমে শেখেন অনেক কিছু।
শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ না থাকলেও সংকরায়ণ করে একের পর এক নতুন ধান উদ্ভাবন করছেন নূর মোহাম্মদ।
এ পর্যন্ত সংকরায়ণের পর নূর মোহাম্মদের কৌলিক সারির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই শ–এর বেশি। এর মধ্যে পাঁচটি সারি জাত হিসেবে স্বীকৃতির যোগ্য বলে তিনি মনে করেন।
সবশেষ নূর মোহাম্মদ স্বল্প জীবনকালের সরু ধানের নতুন সারি উদ্ভাবন করেছেন। এর নাম দিয়েছেন ‘নূর ধান-২’। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য, বপন থেকে কাটা পর্যন্ত ১৩০ দিন সময় লাগবে। ধান পেকে গেলেও পাতা সবুজ থাকবে।
গাছ খাটো, এ জন্য ঝড়ে হেলে পড়ে না। বোঁটা শক্ত হওয়ার কারণে ঝড়ে এই ধান শিষ থেকে ঝরে পড়ে না। গাছের উচ্চতা ৮৭ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার।
ধানের ছড়ার দৈর্ঘ্য ২৫ থেকে ২৬ সেন্টিমিটার। কুশির সংখ্যা ৮ থেকে ১০টি। আগাম কাটা যাবে। এ জন্য সেচও কম লাগবে। প্রায় নয় বছরের গবেষণায় তিনি এই নতুন ধান উদ্ভাবন করলেন।
নূর মোহাম্মদের দাবি, দেশে বোরো মৌসুমে এর চেয়ে কম জীবনকালের ধান নেই। এর পরেই আছে বাংলামতি।
সময় লাগে ১৩৫ দিন। এর আগে তিনি একই জীবনকালের এনএমকেপি-৫ ধান উদ্ভাবন করেছিলেন। এনএমকেপির অর্থ হচ্ছে ‘নূর মোহাম্মদ কৃষি পরিষেবা’।
এবার ধানের চেয়ে এনএমকেপি-৫–এর চাল মোটা। গাছ এত খাটো ছিল না।
এ ছাড়া আমন মৌসুমের জন্যও তিনি খরাসহিষ্ণু ও স্বল্প জীবনকালের আরও দুই জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন।
কৃষি উৎপাদনে সাফল্যের জন্য নূর মোহাম্মদ ২০০৫ সালে পান রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক। সেরা কৃষি উদ্ভাবন ক্যাটাগরিতে ২০১৮ সালে তীর-প্রথম আলো কৃষি পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
সুত্র- প্রথম আলো