ভবনের সংস্কার চলছে। কাজ এগিয়ে নিচ্ছে প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা। জুলাই ম্যাসাকারের অগোছালো মামলা নিয়ে যখন নানা মহলে প্রশ্ন উঠছে তখন সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, সহসাই পুরো প্রক্রিয়ায় গতি আসবে।
ইতিমধ্যে হাইকোর্টে ২৩ জন বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। চলতি সপ্তাহেই ট্রাইব্যুনালে বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হতে পারে। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে বিচার প্রক্রিয়া।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার বিচার শুরু হলে সকল দ্বিধা, প্রশ্ন কেটে যাবে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ট্রাইব্যুনালে এরইমধ্যে ৪৫টি এবং তদন্ত সংস্থায় ১৬টি অভিযোগ জমা পড়েছে।
সবমিলে ৬১টি অভিযোগ পড়েছে।
বেশিরভাগ অভিযোগই আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও পুলিশের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পড়েছে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। তিনি ইতিমধ্যে দেশত্যাগ করেছেন।
অন্য অভিযুক্তদের একটি বড় অংশও এরইমধ্যে দেশত্যাগ করেছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এ প্রেক্ষাপটে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পরপরই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্ত মূল আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করা হবে।
ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী হাজিরের ব্যাপারে বড় ধরনের চমক থাকতে পারে। মামলার তদন্ত পদ্ধতিতেও চমক থাকবে।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাজুল ইসলাম গনমাধ্যমকে বলেন, সবগুলো অভিযোগ এলাকা/জোন ওয়ারী ভাগ করা হবে। এরপর সংশ্লিষ্ট এলাকার অভিযোগগুলো একসঙ্গে তদন্তের কার্যক্রম শুরু হবে।
তিনি বলেন, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। আবার কারও প্রতি জুলুমও করা হবে না। এটা হবে এমন একটা বিচার যে বিচারের পরে শহীদ পরিবার, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার, বাদীপক্ষসহ আসামিপক্ষও মনে করবে তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করা হয়েছে।
এ বিচার কার্যক্রমে দু’টি চ্যালেঞ্জ। এক, বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে।
প্রত্যেকটা জায়গায় একটা কমন ইনস্ট্রাকশন ছিল গুলি করে সব মেরে ফেলা। এ অপরাধের যে আলামতগুলো সেগুলো সংগ্রহ করা, কম্পাইল করা।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আসামিরা এখনো পলাতক, বিশেষ করে প্রধান আসামি দেশত্যাগ করেছেন। অনেকে এখনো দেশত্যাগের চেষ্টায় আছেন। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসাটাও চ্যালেঞ্জ।
গণহত্যা চালানোর অভিযোগের প্রধান আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কীভাবে বিচারের সম্মুখীন করবেন- এমন প্রশ্নে আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, আইনগতভাবেই শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব।
তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আইনি প্রক্রিয়া সেটা আমরা শুরু করবো। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অপরাধী প্রত্যর্পণ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে ২০১৩ সালে। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে এ চুক্তিটি হয়েছিল।
এই বন্দি বিনিময় চুক্তির মাধ্যমেই তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
যেহেতু অধিকাংশ মামলায় তাকে গণহত্যার প্রধান আসামি করা হয়েছে। সুতরাং এ প্রক্রিয়া শুরুর মাধ্যমে তাকে আইনগতভাবে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা করবো।
কথা হয় প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ৬১টি অভিযোগের মধ্যে বেশিরভাগ মামলা ঢাকার যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, উত্তরা-আজমপুর, রামপুরা-বনশ্রী, বাড্ডা, মিরপুর ও আশুলিয়া এলাকায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা।
ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহ ও লক্ষীপুর থেকেও অভিযোগ পড়েছে।
প্রায় প্রতিটি মামলাতেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন হলে এসব মামলার প্রধান আসামি শেখ হাসিনাসহ মূল আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়না জারির আবেদন করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রসিকিউটর বিএম সুলতান বলেন, ট্রাইব্যুনালের বিচারক কারা হচ্ছে সে বিষয়ে তার কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে চলতি সপ্তাহেই ট্রাইব্যুনালে তিনজন বিচারক নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জমা পড়া মর্মান্তিক ৬১ অভিযোগের মধ্যে কিছু অভিযোগ চরম মর্মান্তিক।
গণহত্যাকারীরা শিক্ষার্থীদের শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। লাশ দাফন ও গোসলেও বাধা দেয়। এমনই একজন শহীদ শেখ ফাহমিন জাফর। লাশ গোসলেও বাধা দেয়।
এ বিষয়ে গত ১৮ই সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করেছেন শহীদ শেখ ফাহমিনের মা কাজী মাখমিন শিল্পী।
অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও উত্তরা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দসহ ৩৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, শহীদ শেখ ফাহমিন জাফর। ১৮ বছরের কিশোর। ছিলেন টঙ্গী সরকারি কলেজের ইন্টারমিডিয়েট প্রথমবর্ষের ছাত্র। গ্রামের বাড়ি নওগাঁর আত্রাই উপজেলার তারাটিয়া গ্রামে।
১৮ই জুলাই সকাল। ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে। মায়ের অনুমতি নিয়ে আন্দোলনে যোগ দেন ফাহমিন।
আন্দোলনে যাওয়ার সময় মাকে একটি আরজি জানান।
মাকে বলেন, আমি যদি আন্দোলনে শহীদ হই তবে আমার লাশ যেন ঘরে না আনা হয়। লাশ নিয়ে সোজা গণভবনে যাওয়া হয়। আন্দোলন সফল না হওয়া পর্যন্ত লাশ গণভবন থেকে যেন নিয়ে আসা না হয়।
এ কথা বলে উত্তরা আজমপুর সুপার মার্কেট এলাকায় সংঘটিত হওয়া আন্দোলনে যোগ দেন ফাহমিন।
ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। শহীদ হন ফাহমিন। ঢাকার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে পাওয়া যায় তার লাশ। লাশ দাফন করানোর জন্য গোসল করাতে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় উত্তরার স্থানীয় মসজিদ কমিটি লাশ গোসল করাতে বাধা দেয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ জাফরের শার্টের পকেটে রক্তাক্ত অবস্থায় তার লেখা দু’টি কবিতা পাওয়া যায়। একটি কবিতা সিঁড়ি।
আজ স্বাধীনতার পর, কেন স্বাধীন দেশের ছাত্রের রক্ত ঝরলো? কেন তাদের প্রাণ গেল? যে কথা বলার স্বাধীনতা নেই। কেমন স্বাধীনতা পেলাম? যেখানে আন্দোলনে গুলি ছোড়ে! স্বাধীনতার মূল্য কোথায়?
পরাধীন রাষ্ট্রে ভাই রফিক, জব্বারের রক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রে ভাই সাঈদ, রাফির রক্ত। তাহলে কী স্বাধীনতা পাইনি। স্বাধীনতা পেলাম তো রক্ত কেন দিলাম? রক্ত দিলাম তোর স্বাধীন দেশে তাই রক্ত দিয়ে আবার স্বাধীনতা আনবো।
আরেকটি কবিতা- হয়তো মানুষ হতে চাই…। বিষ মতন ওষুধ চাই, বেঁচে থাকতে দোয়া চাই। মৃত আত্মায় প্রাণ চাই জীবিত দেহে কাফন চাই। মহাকালের ভুল পথে সুপথ চাই সুপথে চলতে পা চাই।
মস্তিষ্কে বিবেক চাই বিবেক, ভালো-মন্দ বিচার করতে চাই। মরে যেয়েও বেঁচে আছি আমি… মরে যেয়েও বেঁচে আছি আমি। বিশ্রি থেকে শুশ্রি হতে চাই সর্বোপরি মানুষ হতে চাই।
এমন আরও অনেক ঘটনার অভিযোগ রয়েছে। শহীদ পরিবারের দাবি, আমরা কিছুই চাইনা। শুধু চাই পুত্র হত্যার বিচার। তবে বিচারটা যেন দীর্ঘসূত্রীতায় পড়ে না থাকে। জীবদ্দশায় যেন বিচার দেখে যেতে পারি।
গত ৫ই আগস্ট বিকালে সাভারের আশুলিয়ায় শহীদ হন মানারত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সির্টির ত্রিপলী ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী আহনাফ আশরাফ উল্লাহ।
এ বিষয়ে শহীদ আহনাফের বোন ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী সাইদা আক্তার গনমাধ্যমকে বলেন, গত ৫ই আগস্ট শহীদ হয় আমার একমাত্র ভাই আহনাফ। ওর স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে দেশ মাতৃকার জন্য কাজ করা।
কিন্তু আল্লাহ তার আগেই এই দেশের স্বাধীনতার জন্য কবুল করেছেন।
এখন আর ভাই এর জন্য কান্না করি না। ওকে ভাই পরিচয় দিতে আমি গর্ববোধ করি।
এই সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি, আমার ভাইসহ সব শহীদ হত্যার বিচার চাই। আইনের মারপ্যাচে যেন কেউ বের হয়ে যেতে না পারে।
খুব দ্রতই পুনর্গঠন হবে ট্রাইব্যুনাল। এরই মধ্যে গত ১৮ই সেপ্টেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত পরিচালনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে ১০ কর্মকর্তার সমন্বয়ে তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করে পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
তদন্ত সংস্থায় কো-অর্ডিনেটর পদে মো. মাজহারুল হককে (এডিশনাল ডিআইজি, অবসরপ্রাপ্ত) এবং কো-কোঅর্ডিনেটর পদে মুহাম্মদ শহিদুল্যাহ চৌধুরীকে (পুলিশ সুপার, অবসরপ্রাপ্ত) যোগদানের তারিখ থেকে পরবর্তী দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
সূত্র – মানবজমিন