হাঙ্গেরির পাপাতেসজার, মিয়াওয়াকি পদ্ধতি এবং টেকসই পরিবেশবান্ধব গ্রাম

ফজলুর রহমান

টেকসই পরিবেশবান্ধব গ্রামইউরোপের হাঙ্গেরির পাপাতেসজার গ্রাম। এই গ্রামকে বলা হচ্ছে যেন এক টাইম মেশিন। যা পাখির চোখে দেখলে মনে হয়, শত বছর আগের কোনো এলাকা। যা সাজানো গোছানো, অবিকৃত, অবিকল বছরের পর বছর।

ওই পুরো গ্রামটাতে নেই বহুতল কোনো ভবন। পানি তোলার কিংবা খাবার প্রক্রিয়ার কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে প্রাচীন রীতি। এমনকি কারো চোখে পড়েনা মোবাইল টাওয়ার, গাড়ি কিংবা বৈদ্যুতিক কোনো লাইন।

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদন মতে, এসবের মূলে রয়েছে পুরো গ্রামটি গড়ে তোলা হয়েছে পরিবেশ বান্ধব ধারণার ভিত্তিতে।

ব্যবহার করা হয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি। বায়োগ্যাস আর সোলার প্যানেলের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয় জ্বালানি।

এখানকার টাউনের মেয়র বেলা ভলফিংগার বলেন, প্রতিটি বাড়িতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যবহৃত হয় সৌর প্যানেল।

গ্রামের যেকোন অবকাঠামো নির্মানের ব্যাপারে আমার প্রথম শর্তই থাকে কিভাবে পুরো ব্যাপারটিকে ইকো-ফ্রেন্ডলি করা যায়।

তবে সবসময় আমার সাথে একমত পোষণ করেন না অনেক প্রকৌশলী। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল।

ওই গ্রামে যেন মধ্যযুগের আদল আর আধুনিক ধারণার সমন্বয়ে তৈরী করা হয়েছে একেকটি বাড়ি।

কংক্রিটের স্থাপনার পরিবর্তে প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদানের ব্যবহার আর টেকসই স্থাপনার মাধ্যমে তৈরী হয় এসব বাড়ি।

ওই গ্রামের অধিবাসীরা বলেন, যখন দেখলাম সবাই সোলার প্যানেল ব্যবহার করছে তখন আমিও সিদ্ধান্ত নেই সোলার প্যানেল স্থাপন করার।

এই ১০ কিলো-ওয়াট সিস্টেম আমার ফ্যাক্টরির জন্য যথেষ্ট। এমনকি আমার বাড়ির বিদ্যুতের চাহিদার পুরোটাই মিটে যায়।

পাপাতেসজার গ্রামে বাসিন্দার সংখ্যা মাত্র ১২শ। তবে দূষণমুক্ত এবং পরিবেশবান্ধব হওয়ার কারণে গ্রামটিকে ঘিরে আগ্রহ বাড়ছে মানুষের।

একদিকে এলাকাটিতে বৃদ্ধি পেয়েছে পর্যটকদের সংখ্যা। অন্যদিকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্যও অনেকে আসছেন গ্রামটিতে। ২০২৩ সালে ইউরোপিয়ান ক্লাইমেট স্টার অ্যাওয়ার্ডও অর্জন করে গ্রামটি।

এবার আরেকটি গ্রামের খবর শোনা যাক মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে।

‘গ্রাম থেকে শুরু হোক জলবায়ু রক্ষার আন্দোলন’- এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এগিয়ে জার্মানি ।

একসঙ্গে কাজ করে ক্ষতিকারক কার্বন গ্যাস নিঃসরণ কমানোর এই আন্দোলনে সেখানে অংশীদার সাধারণ মানুষ৷

এরফলে জার্মানির গ্রামগুলোতে পাহাড় আছে, নদী আছে, পাখি আছে।

এখানকার একটি কাউন্টির নাম কখেম সেল৷ ২০৫০ সালের মধ্যে এই জায়গাটি হয়ে উঠবে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ক্ষতিকারক কার্বন গ্যাস মুক্ত এলাকা৷

সেই ২০০৮ সালে ঐ কাউন্টির মানুষ তাদের জায়গাটিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ধকল থেকে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আর এ জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা মোজেল নদী উপত্যকার ৬৫ হাজার বাসিন্দার৷ বলা হচ্ছে, ইউরোপের প্রতিটি গ্রামকে ক্ষতিকারক কার্বন দূষণ মুক্ত করার প্রত্যয়ের সূচনা যে হচ্ছে এই কখেম সেল থেকেই!

কার্বন নিঃসরণ শূন্য মাত্রায় নিয়ে আসতে তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং বায়ো ফুয়েলে চাহিদা মেটাচ্ছেন।

তাছাড়া এমন সব প্রযুক্তি ঘর গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করছেন, যাতে স্বল্পমাত্রায় জ্বালানি প্রয়োজন হয়।

কেবল যে ঘরের কাজেই এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নয়, স্কুল দোকান, অফিস সব জায়গায় বিশেষ পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে সেখানে।

এ সব কাজে সেখানকার প্রশাসনের সঙ্গে ৩৮টি সহযোগী প্রতিষ্ঠান এ হয়েছে৷ আগামী ৪০ বছরে এই কাউন্টির এই কাজের জন্য তিন বিলিয়ন ইউরোর একটি বাজেটও করা হয়েছে৷

কেবল জার্মানি নয়, চেষ্টা শুরু হয়েছে অনেকে দেশেই৷ চেক রিপাবলিকের হোস্টেটিম গ্রামের মানুষ বায়োমাস থেকে বানাচ্ছেন হিটিং প্লান্ট, ফেলে দেয়া খাবার থেকে বানানো হচ্ছে সার।

সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, স্লোভেনিয়ার মতো দেশগুলোর গ্রাম পর্যায়ে জ্বালানি থেকে শুরু করে মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় সকল কাজে যেন পরিবেশ এবং জলবায়ু রক্ষা পায় সেই কাজ করার চেষ্টাই করছেন।

পরিবেশবান্ধব গ্রাম গড়তে অন্যতম প্রয়োজন প্রচুর সবুজ প্রকৃতি। সেই সবুজ গড়ার একটি উপায় বাতলে দিয়েছেন জাপানের বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ আকিরা মিয়াওয়াকি।

তিনি সত্তরের দশকে একটি পদ্ধতির প্রবর্তন করেন যার মাধ্যমে খুব দ্রুতই ঘন জঙ্গল বা বন তৈরি করা সম্ভব।

এই প্রক্রিয়ায় বড় জায়গার প্রয়োজন হয় না। আর তিন বছর পর এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও নেওয়ার দরকার হয় না। অভিনব এই পদ্ধতির নাম ‘মিয়াওয়াকি’।

মাত্র ৩০ বর্গ ফুট জায়গাতেও মিয়াওয়াকি পদ্ধতির মাধ্যমে জঙ্গল বানানো সম্ভব। সত্তরের দশকে ড. মিয়াওয়াকি জাপানের পতিত জমিতে বনায়নের উদ্দেশ্যে এই প্রক্রিয়ার উদ্ভাবন করেন।

এই পদ্ধতিতে মিয়াওয়াকি মূলত স্থানীয় প্রজাতির গাছ বাছাইয়ে গুরুত্বারোপ করেন। এতে গাছগুলো সহজেই স্থানীয় পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং যে বন সৃষ্টি হয় তা টেকসই হয়।

মিয়াওয়াকি জাপানসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ১,০০০ এরও অধিক ছোট জঙ্গল বা বন তৈরি করেন।

বর্তমানে তার এই পদ্ধতি ব্যবহার করে নেদারল্যান্ড, ভারতসহ বেশ কিছু দেশ মিয়াওয়াকি ফরেস্ট তৈরি করছে।

দেখা গেছে, প্রতি বছর গড়ে সাধারণ গাছের তুলনায় মিয়াওয়াকি পদ্ধতিতে বেড়ে ওঠা গাছগুলো ১০ গুণ দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায়। বছরে অন্তত ১ মিটার বৃদ্ধির নিশ্চয়তা থাকে।

এতে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ২০-৩০ বছরের মধ্যেই গভীর বনভূমি তৈরি করা সম্ভব, যা প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হতে কয়েকশো বছর লেগে যায়।

তাছাড়া প্রক্রিয়াটি শুরু করার ২-৩ বছর পর এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করার কোনো ঝামেলা থাকে না।

এসব গাছ নিজেরাই দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এক্ষেত্রে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের কোনো দরকার হয় না।

মিয়াওয়াকি পদ্ধতির গাছগুলো প্রায় ৩০ গুণ বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে থাকে।

এ ধরনের বনায়নের ফলে যেসব অঞ্চলের গাছপালা প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সেসকল এলাকায় পুনর্বনায়ন করা সম্ভবপর হয়।

প্রচলিত বৃক্ষরোপণের তুলনায় এই প্রক্রিয়ায় একই জায়গায় ৩০ বা ততোধিক ধরনের গাছ লাগানো যায়।

মিয়াওয়াকি জাপানসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ১,০০০ এরও অধিক ছোট জঙ্গল বা বন তৈরি করেন।

মিয়াওয়াকি বন বা জঙ্গল তৈরির জন্য মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা, পানির অনুপ্রবেশ ও বাতাস চলাচলের ক্ষমতা, জৈব বস্তুর পরিমাণ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য জানা প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে সেই স্থানের মাটি বেলে, দোআঁশ নাকি এঁটেল- সেটাও পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এজন্য একমুঠো মাটিতে পরিমাণ মতো পানি মিশিয়ে একটা গোল বল বানানোর চেষ্টা করতে হবে।

মাটিতে বালি বা বেলে মাটির পরিমাণ বেশি হলে তা বল তৈরির সময়ই ভেঙে যাবে।

মাটির বল বানানোর পর সেটাকে চ্যাপ্টা ফিতার মতো করার চেষ্টা করতে হবে। ফিতা যত লম্বা হবে, মাটিতে কাদার পরিমাণও তত বেশি।

দোআঁশ মাটি বৃক্ষরোপণের জন্য আদর্শ- এখানে বালি ও কাদার একটি যথাযথ সংমিশ্রণ থাকে।

বেলে বা এঁটেল মাটি হলে এতে কিছু উপকরণ দিয়ে বৃক্ষরোপণের উপযোগী করে তুলতে হয়।

যেমন- বেলে মাটির ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপাদানের সংযোগে এর পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজন পড়ে।

মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কোকোপিট বা শুকনো আখের ছিবড়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।

আর বাতাস চলাচলের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ধান কিংবা গমের তুষ ব্যবহার করা যেতে পারে।

মাটিতে বিভিন্ন জৈব ও অজৈব উপাদান বৃদ্ধি করার জন্য ভার্মি কম্পোস্ট কিংবা গরুর গোবর, ছাগলের বর্জ্য ইত্যাদি প্রয়োগ করা যেতে পারে।

মিয়াওয়াকি পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু জটিল একটি ধাপ হলো- অঞ্চলভেদে স্বাভাবিক বা স্থানীয় প্রজাতির গাছের তালিকা তৈরি করা।

যদি নির্বাচিত এলাকার আশেপাশে ৫০-১০০ মিটারের সীমানায় কোনো বন বা জঙ্গল থাকে, তাহলে সেই জায়গায় কী কী গাছ আছে সেটার তালিকা করাই ভালো।

তবে আশেপাশে বনাঞ্চল না থাকলে সেই এলাকা সম্পর্কে জানা আছে এমন কোনো বিশেষজ্ঞ কিংবা অঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে কাজটা করা লাগবে।

গাছ বাছাই করার পর সেসব গাছের বীজ সংগ্রহ করে নার্সারি তৈরি করতে হবে কিংবা সরাসরি ৬০-৮০ সেন্টিমিটার লম্বা চারাগাছ কিনতে হবে।

এই বনে গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, অর্ধেক বৃক্ষজাতীয় গাছ লাগালে চার ভাগের এক ভাগ মাঝারি উচ্চতার গাছ এবং বাকি জায়গায় ঝোপজাতীয় গাছ লাগাতে হবে।

মূলত চার ধরনের স্তর এখানে ব্যবহার করতে হবে, যেমন- স্রাব ট্রি, সাব-ট্রি, ট্রি এবং ক্যানোপি।

ট্রি বলতে বোঝানো হচ্ছে বৃক্ষজাতীয় গাছকে। স্রাব ট্রি হলো বৃক্ষের তুলনায় ছোট গাছগুলো, এবং সাব-ট্রি হলো মূলত পরজীবী উদ্ভিদ।

বনের ভেতরে বড় বড় গাছগুলো একত্রিত হয়ে উপরের দিকে একটি আচ্ছাদন সৃষ্টি করে, যার ফলে সূর্যের আলো মাটিতে পৌঁছাতে পারে না। এই আচ্ছাদনই হলো ক্যানোপি।

এরকম গাছও মিয়াওয়াকি বনভূমিতে দরকার। এভাবে ৩০ বা ততোধিক প্রকারের গাছ একটি মিয়াওয়াকি বনে লাগানো যেতে পারে।

যে জায়গায় বন তৈরি করা হবে সেটা প্রস্থে অন্তত ৩ মিটার হতে হবে।

তবে চার মিটার বা এর অধিক এলাকা নেয়াই শ্রেয়। পানির পাইপলাইনের নকশা করার ক্ষেত্রে এই বিষয়ে অভিজ্ঞ এমন কাউকে দিয়ে কাজ করাতে হবে।

প্রথম দুই থেকে তিন বছর গাছগুলোকে নিয়মিত পানি দেয়ার প্রয়োজন হয়। এই সময়ের পরে অবশ্য বনটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে।

সাধারণত বর্ষাকাল ছাড়া বছরের যেকোনো সময়ে এই প্রক্রিয়ায় গাছ লাগানো শুরু করা যেতে পারে।

আমাদের অবস্থা এমন যে, শহরবাসীর সুযোগ-সুবিধা ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিয়ে যতটা ভাবি, গ্রামের মানুষের কথা সেভাবে ভাবি না।

পল্লী পরিবেশ অনেকটা পরিকল্পনাহীনভাবে চলছে। অথচ গ্রামের লোকজনেরও রয়েছে সুন্দর বাসস্থান ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ উপভোগের অধিকার।

প্রকৃতির আশীর্বাদের প্রাচুর্য গ্রামে আগের মতো নেই। নানা প্রয়োজনে আমরা বনের গাছ কেটে জমি ফাঁকা করছি, ঘরবাড়ি ও রাস্তা বানাচ্ছি, খামার তৈরি করছি।

তাই প্রকৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করেই গ্রাম উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সেই পরিকল্পনা হতে হবে সুসমন্বিত, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই।

লেখক: উপ-পরিচালক, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।

মতামত দিন