জুলাই-আগস্টে যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলছিল, তখন সমালোচনার পুরোভাগে ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
ইন্টারনেট কারসাজি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে তাঁর আবোলতাবোল কথায় রীতিমতো ‘ভিলেন’ বনে যান তিনি।
শুধু আন্দোলনের সময়টাই নয়; গনমাধ্যম অনুসন্ধান বলছে, রাজনৈতিক অধ্যায়ে জুনাইদ আহমেদ পলক আগাগোড়াই ছিলেন ভয়ংকর এক ভিলেন! পলকে পলকে দিতেন পল্টি। চেনাতেন নিজের জাত।
দাপট দেখিয়ে শশব্যস্ত রাখতেন প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি কিংবা আমলাকে।
নিজের চাল-চলনের মতোই খামখেয়ালিতে ভরা ছিল তাঁর হাতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ আইসিটি মন্ত্রণালয়। পলককে বলা হয় প্রযুক্তি খাতের মাফিয়া।
সোনার ডিমপাড়া হাঁসের মতোই এই মন্ত্রণালয়কে ব্যবহার করেছেন নিজের প্রয়োজনমতো।
পদে পদে ঘুষ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কমিশন, উন্নয়নের নামে একের পর এক লুটপাটের প্রকল্প তৈরি, নিয়োগ বাণিজ্য, ভয়ভীতি ও হুমকি-ধমকি দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটেছেন।
আইসিটি খাতের সব প্রকল্প থেকেই ১৫ শতাংশ পলকের পকেটে যাওয়াটা ছিল
অলিখিত নিয়ম। অবৈধভাবে অর্জিত প্রায় সব টাকাই তিনি পাচার করেছেন।
এদিকে, শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করা তাঁর স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকাও কম যাননি।
স্বামীর প্রতাপ আর টাকার গরমে তিনি শিক্ষকতার মতো মহান পেশা ছেড়ে হয়েছেন পলকের ‘টাকার সিন্দুক’।
শুধু পলকের নির্দেশে বিভিন্ন অপকর্ম তামিল করে তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ এখন শত শত কোটি টাকার মালিক।
তবে গেল ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সবাই একযোগে পালিয়েছেন এলাকা ছেড়ে।
আর পলক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এখন কারাবন্দি।
রাজনীতির মাঠে যেভাবে উদয়
বাবা ফয়েজ উদ্দীন আহমেদ করতেন আওয়ামী লীগের রাজনীতি; ছিলেন সিংড়া উপজেলার সভাপতি। সেই সূত্রে পলকও আওয়ামী লীগার। সিংড়ার রাজনীতির মাঠে পলক তখন আনকোরা খেলোয়াড়।
২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচন এলে দলের মনোনয়ন চেয়ে বসেন তিনি।
প্রথমে না পেয়ে শেখ হাসিনার বাসভবনের সামনে ‘গোমড়া মুখে’ অবস্থান নেন পলক। পরে মতিয়া চৌধুরীর যোগসূত্রে শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়ে নৌকার মনোনয়ন বাগিয়ে নেন।
সে সময় এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা ধারদেনা করে নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দেন।
২০০৮ সালে নবম, ২০১৪ সালে দশম, ২০১৮ সালে একাদশ ও ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে তিনি নাটোর-৩ (সিংড়া) আসন থেকে সংসদ সদস্য হন।
২০১৪ সালে এমপি হওয়ার পর তাঁকে দেওয়া হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব।
এর পর একাদশ ও দ্বাদশ সংসদেরও একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। প্রতিমন্ত্রিত্ব পেয়েই যেন খুলে যায় তাঁর ‘ভাগ্য’।
প্রকল্প নিয়ে টাকার খেলা
টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির গল্পটা জানা ছিল সবার। বছর বছর ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে নেওয়া হতো মোটা বাজেটের বড় বড় প্রকল্প।
২০০৯-১০ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত এ খাতে বিনিয়োগ করা হয় ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের রয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প।
এত এত টাকা খরচায়ও ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রকৃত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত দেশের মানুষ। অভিযোগ রয়েছে, শুধু মোবাইল নেটওয়ার্ক ফোরজি করার সময়েই কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট করেন পলক।
তাঁর দুর্নীতির অন্যতম উৎস ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি, এটুআই প্রকল্প, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, হাই-কেট পার্ক, আইটি পার্ক। আইসিটি খাতে উন্নয়নের নামে এসব প্রকল্প ছিল পলকের ‘আলাদিনের চেরাগ’।
সম্প্রতি বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ছয় খাতে মোটা অঙ্কের টাকার অনিয়ম পায় মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) কার্যালয়।
হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের হিসাব সম্পর্কিত কমপ্লায়েন্স নিরীক্ষা প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ সারাদেশে ৯২টি হাই-টেক পার্ক, সফটওয়্যার পার্ক ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করছে।
এর মধ্যে ১৮টি পার্কে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চলমান। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পার্ক কর্তৃপক্ষের নিজস্ব আয় বাজেটে অন্তর্ভুক্ত না করে অতিরিক্ত অনুদান নেওয়ার বিষয়ে বড় অনিয়ম হয়েছে।
লুটপাটের অংশ হিসেবে কয়েকটি প্রকল্প শেষ এবং কিছু কিছু বাস্তবায়নাধীন দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচের কথা বলা হয়।
এর মধ্যে প্রযুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ছিটমহলগুলোতে আইসিটি প্রশিক্ষণ, ভার্চুয়াল ডেস্কটপ কম্পিউটিং নেটওয়ার্ক ল্যাব স্থাপন, লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রশিক্ষণ, সম্ভব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প, ইলেকট্রনিক নথি ব্যবস্থাপনা, ফ্রিলেন্সার টু এন্ট্রাপ্রেনিউর উন্নয়ন, মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট প্রস্তুতি, ডিজিটাল টকিং বুক তৈরি, জাতীয় পর্যায়ে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন উন্নয়ন দক্ষতা, বাড়িতে বসে প্রশিক্ষণ, সাইবার নিরাপত্তা, ইনোভেশন ফর স্মার্ট গ্রিন বিল্ডিং, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, ই-শপ কর্মসূচি, মোবাইল গেম উন্নয়ন, তৃণমূলের তথ্য জানালা কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য।
এর মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে শুধু মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশন দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পেই ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত খরচ দেখানো হয় ৩৩০ কোটি টাকা, এটুআইয়ে ২০২০ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত খরচ দেখানো হয় ৮৫৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, দীক্ষা-দক্ষতা উন্নয়নে অনলাইন শিক্ষা প্রকল্পে ২০২১ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত ২৭৫ কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়।
লুটপাটের অভিপ্রায়ে আরও ভূরি ভূরি প্রকল্পের আয়োজন করেছিলেন পলক।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন প্রকল্পে ৫ হাজার ৯২৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা, প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্পে ২৮৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা, উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠাকরণে ৪৪২ কোটি ৮৩.১৪ লাখ টাকা, তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণে ১৫৮ কোটি ৯৬.৬৯ লাখ টাকা, টেলিযোগাযোগ খাতে কানেক্টেট বাংলাদেশ প্রকল্পে ৫০৪ কোটি ৪৩.৩১ লাখ টাকা, এনভায়রনমেন্টাল এবং সোশ্যাল ম্যানেজমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক (ইডিজিই) প্রকল্পে ২ হাজার ৫৪১ কোটি ৬৪.৯৭ লাখ টাকা, ভিডিও কনফারেন্সিং শক্তিশালীকরণ প্রকল্পে ৪৯৫ কোটি ১.১২ লাখ টাকা।
সবচেয়ে বড় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে হাই-টেক পার্ক প্রকল্প ঘিরে।
শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টারের ১১টি প্রকল্পে সংশোধিত মিলিয়ে খরচ দেখানো হয় ১ হাজার ৩৭০ কোটি ৭৩.৩৯ লাখ টাকা, আইটি বা হাই-টেক পার্ক স্থাপনে ১ হাজার ৮৪৬ কোটি ৯ লাখ টাকা, বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি প্রকল্পে ৪৩১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, ইকো সিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্পে ৩৫৩ কোটি ৬ লাখ টাকা, ভারত-বাংলাদেশ ডিজিটাল সেবা প্রকল্পে ৭৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি প্রকল্পে ১ হাজার ১১৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং শেখ রাসেল ল্যাব স্থাপন প্রকল্পে ৯৩৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রকল্পের মতোই নামধারী আরও ভুঁইফোঁড় প্রকল্প বানিয়ে লুটপাট চালিয়েছে পলক সিন্ডিকেট।
ফাইভস্টার সিন্ডিকেট
নামে-বেনামে সিংড়া ও আশপাশের এলাকায় হাজার হাজার বিঘা জমি কিনেছেন পলক।
সেই সঙ্গে চাকরি, বদলি বাণিজ্য, চাঁদাবাজির কমিশন, খাসজমি বরাদ্দসহ অসংখ্য অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। নিজ এলাকায় ‘ফাইভস্টার’ নামে একটি সিন্ডিকেট বাহিনী রয়েছে পলকের।
এই বাহিনীর সদস্যদের একজন হলেন পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি ছিলেন সিগারেট বিক্রেতা।
পরে মাটি-বালুর ব্যবসা, ইটভাটা, গরুর খামার, সরকারি জমি দখল করে দোকান বাণিজ্য, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, মহাসড়কে চাঁদাবাজি, ডিও ব্যবসা ও সরকারি শতাধিক পুকুর দখল করে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
আরেক সদস্য সাজ্জাদ হোসেন আগে আতর, সুরমা ও টুপির দোকান করতেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সিংড়া দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হন।
পলকের আস্থাভাজন হওয়ায় পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদটিও বাগিয়ে নেন। তিনি এলাকায় ভূমিদস্যু হিসেবে পরিচিত।
ভুয়া দলিল করে অন্যের জমি দখলে সিদ্ধহস্ত সাজ্জাদ পলকের জমি বাণিজ্যের মূল কারিগর। ওই এলাকার রাজা রমণী কান্ত রায় বাহাদুরের শত শত একর জমি (অর্পিত সম্পত্তি) ভুয়া দলিল বানিয়ে আত্মসাৎ করেন।
এ ছাড়া জমিদার বাগচি, মজুমদার ও মধু ভাদুরির ৭০০ থেকে ৮০০ বিঘা জমি ভুয়া ওয়ারিশ দেখিয়ে দলিল করে নিতে সহায়তা করেন এই সাজ্জাদ। সিংড়ায় আবাসন ব্যবসা রয়েছে সাজ্জাদের।
সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় ইতালি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম।
তিনি পলকের মূল পরামর্শদাতা। জালিয়াতি করে নারী কোটা উপেক্ষা করে ছোট ভাই যুবদলের উপজেলা সেক্রেটারি আনিসুর রহমান লিখনকে নিয়ে দিয়েছেন প্রভাষক পদে চাকরি।
সহোদর এ দুই ভাই পলকের হয়ে এলাকায় বিচার-সালিশ, পুকুর দখল, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য করেন।
উপজেলার চাঁদপুর মহল্লায় রাজপ্রসাদের মতো দুই বাড়ির মালিক এ দুই ভাই।
আরেক সদস্য ডালিম আহম্মেদ ডন পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি।
তাঁর বাবা সাবেক কমিশনার মান্নান পুরো এলাকায় মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন।
পলকের হয়ে গরুর হাট, সরকারি জমি দখল করে দোকান ও গোডাউন বাণিজ্য, শত বিঘা জমিতে মাছের ঘের নির্মাণ, অবৈধ বালুর ব্যবসা, ভূমিহীনদের ঘর দেওয়ার নামে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ ছিল তাঁর হাতে।
শেষজন পলকের শ্যালক লুৎফুল হাবিব রুবেল। সিন্ডিকেটের প্রত্যেক সদস্যর সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা রয়েছে।
এ ছাড়া আলাদাভাবে তিনি আত্রাই নদীর বালু পয়েন্ট নিয়ন্ত্রণ করতেন। অবৈধভাবে তোলা এই পয়েন্টে সব সময় শতকোটি টাকার বালুর মজুত থাকত।
এ ছাড়া লিঙ্গইন ও জোরমল্লিকাতে বালুর পয়েন্টগুলোও ছিল তাঁর। পরিবহন ব্যবসা, ফিলিং স্টেশন, গরুর খামার, নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ ছিল তাঁর উপার্জনের মূল খাত।
সিংড়ার অদূরে চলনবিলের মধ্যে হাই-টেক পার্ক ঘিরে সে এলাকায় শত শত বিঘা জমি কিনে রাখা ও জমির দালালি, দখলবাজিও করেছেন এই রুবেল।
বড় বোন আরিফা জেসমিন কনিকার ব্যবসা ও নগদ টাকা দেখভালের দায়িত্বও ছিল তাঁর।
বোন-দুলাভাইয়ের দেশের বাইরের আইটিসংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ ছিল তাঁর হাতে। তারও ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে দুবাইয়ে।
সেখানেই বর্তমানে অবস্থান করছেন তিনি এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে পারিবারিক একাধিক সূত্র।
এ ব্যাপারে কথা বলতে এলাকায় গিয়ে ফাইভস্টার বাহিনীর সদস্যদের কাউকে পাওয়া যায়নি।
তাদের ব্যক্তিগত অফিসগুলোও ছিল তালাবদ্ধ। মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সেগুলো বন্ধ পাওয়া যায়।
শিক্ষিকা থেকে হঠাৎ উদ্যোক্তা
পলকের সঙ্গে হাজার কোটি টাকার মালিক স্ত্রী কনিকা। তাদের নিকটাত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই জানিয়েছেন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বাড়ি রয়েছে এই দম্পতির।
কনিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে পলক মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি উদ্যোক্তা বনে যান।
পরবর্তী তিন-চার বছরের মধ্যেই কনিকার ব্যাংক হিসাবে জমা হতে থাকে কোটি কোটি টাকা। যে কোনো প্রকল্প নিলেই পলকের হয়ে ১৫ শতাংশ টাকা নেওয়ার দায়িত্ব ছিল কনিকার।
২০০৮ সালে পলক পরিবারের সম্পদ বলতে ছিল সর্বসাকল্যে ১৫ শতক জমি, ব্যাংকে ৫০ হাজার, নগদ ১০ হাজার টাকা।
এরপরই এই দম্পতি বনে যান ভিশন বিল্ডার্স লিমিটেড কোম্পানির ৮০ শতাংশ শেয়ারের মালিক। কনিকার নিজ নামে সিংড়ায় রয়েছে ৪৫০ থেকে ৫০০ বিঘা জমি। ঢাকায় রয়েছে ১৫টি ফ্ল্যাট।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তার নিকটাত্মীয়রা জানান, ছয় মাস আগে কনিকা সিংড়ার চোওড়া গ্রামে জামিলা ফয়েজ ফাউন্ডেশনের নামে ৭০ বিঘা জমি কেনেন।
সেখানে আরও শতাধিক বিঘা জমির বায়না করেছেন তিনি। উদ্দেশ্য, এই স্থানে বাগানবাড়িসহ পার্ক নির্মাণ করার। একইভাবে হাটমুরশন এলাকায় পুলিশের আলোচিত কর্মকর্তা সাকলাইনের কাছ থেকে ৪২ বিঘা জমি কিনে নেন।
এ ছাড়া নাটোর ডিসি অফিসের সামনে গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশে কনিকা তাঁর বাবার নামে প্রায় এক বিঘা জমি কেনেন।
একইভাবে সিংড়া চাঁদপুর মহল্লার তাইজুল কমিশনারের কাছে থেকে প্রায় দুই কোটি টাকায় এবং বালুয়া বাসুয়া এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফজর আলীর জমি কেনেন।
সিংড়া দহপাড়ে কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়িসহ থানার পশ্চিমে উপশহর এলাকায় অত্যাধুনিক একটি বাড়ি কয়েক কোটি টাকায় কিনেছেন।
কনিকার আরও একটি বড় বিনিয়োগ রয়েছে চলনবিল হাই-টেক পার্ক সিটি এলাকার চারপাশে। সেখানে তিনিসহ পলক সিন্ডিকেটের সদস্যরা শত বিঘার ওপরে জমি কেনেন।
এ ছাড়া আশপাশের আরও কয়েকশ বিঘা জমির বায়না করে রেখেছেন তারা।
এ ব্যাপারে পলকের স্ত্রী কনিকা ও শ্যালকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে সমকাল। তবে তাদের দু’জনের মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারা এখন দেশের বাইরে আছেন। তাদের নিকটাত্মীয় সিংড়া বাজারের ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক বলেন, ২০০৮ সালে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৫ শতাংশ জায়গার মালিক ছিলেন পলক।
তাঁর স্ত্রী কনিকা ছিলেন শিক্ষক। এখন তারা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। দুর্নীতি ছাড়া কোনোভাবেই এত টাকা আয় সম্ভব না।
চলনবিলের সর্বনাশ
নাটোরের চলনবিলের মাঝখানে অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ।
ফলে দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা; হচ্ছে কৃষির ক্ষতি। পলকের একক সিদ্ধান্তে চলনবিলের একটি অংশে নির্মাণ করা হচ্ছে হাই-টেক পার্ক, শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার, টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) এবং টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ (টিএসসি)।
এর পাশাপাশি চলনবিলে একটি মিনি স্টেডিয়াম তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে।
চলনবিলের বাসিন্দা আলী হোসেন বলেন, বর্ষায় আশপাশের গ্রামে স্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। আগে চলনবিলের পানি দুটি চ্যানেল দিয়ে প্রবাহিত হতো।
সরকারের এই উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে একটি চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেছে। এখন ফসলি জমির বিস্তীর্ণ এলাকা জলাবদ্ধ থাকে।
এতে ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রায় তিন হাজার বিঘা জমি। একই সঙ্গে বিলের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহেও বিঘ্ন ঘটছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, চলনবিলে অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে পানির স্বাভাবিক গতি প্রবাহ হারিয়েছে।
ফলে বৃহত্তর চলনবিলের জীবকুল, প্রাণিকুল বংশবিস্তারে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির মাছ প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এ ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে বিল ভরাট ও যত্রতত্রভাবে উন্নয়ন এবং পুকুর খননে নদনদীর সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন হওয়ায় চলনবিল যথাসময়ে পানি পাচ্ছে না; আবার সময়মতো পানিও নামতে পারছে না।
হাই-টেক পার্ক এলাকায় ব্রিজের মুখ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে কৃষির মারাত্মক ক্ষতিসাধিত হচ্ছে।
সুত্র- সমকাল