হাত গুটিয়ে পিএসসি। একের পর এক নিয়োগ পরীক্ষা পিছিয়েই যাচ্ছে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানে। নিয়োগের অপেক্ষায় থাকা প্রার্থীরা হতাশার মধ্যদিয়ে দিন পার করছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রায় সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তন এসেছে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে একেবারে নিচের স্তর পর্যন্ত ঢেলে সাজানো হচ্ছে।
তবে পিএসসি বহাল থাকলেও প্রতিষ্ঠানের কোনো কাজ হচ্ছে না। অপসারণ কিংবা পদত্যাগের মতো কোনো ঘটনা পিএসসিতে এখনো ঘটেনি।
সরকার পতনের পর পিএসসির চেয়ারম্যান ও সদস্যরা কার্যত চুপ। তারা দৃশ্যত কোনো কাজ করছেন না।
বিসিএসসহ চাকরির সব ধরনের পরীক্ষাগুলো একের পর এক স্থগিত করা হচ্ছে। এতে স্থবির হয়ে পড়েছে নিয়োগ প্রক্রিয়া। বিপাকে পড়েছেন চাকরিপ্রার্থীরা।
পিএসসি সূত্র জানিয়েছে, সরকার পতনের পর সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও সদস্যরা ধরেই নিয়েছেন যে, তাদের সরিয়ে দেওয়া হবে।
যেহেতু তাদের রাষ্ট্রপতি সরাসরি নিয়োগ দিয়ে থাকেন, সেজন্য তারা পদত্যাগ না করে সরকারের নির্দেশনার দিকে চেয়ে আছেন। অনেকে নিয়মিত অফিসও করছেন না।
ফলে পিএসসিতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি জানিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হলেও কোনো সাড়া মেলেনি বলে জানান পিএসসির কর্মকর্তারা।
একের পর এক নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত
কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিলে গত ১৮ জুলাই থেকে বিসিএসসহ নিয়োগ পরীক্ষাগুলো স্থগিত করতে শুরু করে পিএসসি।
৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা চলছিল। সেটা স্থগিত করেছে পিএসসি। ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষাও স্থগিত রয়েছে।
আর ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ হলেও খাতা মূল্যায়নসহ অন্য কাজগুলো থমকে আছে।
এছাড়া বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা, চাকরিরতদের বিভাগীয় পদোন্নতির পরীক্ষাগুলোও স্থগিত করেছে পিএসসি। সবশেষ শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) পরীক্ষা শুরুর একদিন আগের রাতে বিসিএস ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রথম অর্ধ-বার্ষিকী বিভাগীয় পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।
একই সঙ্গে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ‘ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (দশম গ্রেড)’ পদের ব্যবহারিক পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়।
স্থগিত এসব নিয়োগ ও পদোন্নতির পরীক্ষার সংশোধিত সময়সূচি পরবর্তীসময়ে পিএসসির ওয়েবসাইট ও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রার্থীদের জানিয়ে দেওয়া হবে বলে সব সময় উল্লেখ করে আসছে পিএসসি।
অথচ স্থগিত কোনো পরীক্ষার নতুন সময়সূচি ঘোষণা করতে পারেনি সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি।
৪৪তম বিসিএসে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন সিরাজুল ইসলাম মুন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সাবেক শিক্ষার্থী। তার সঙ্গে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মৌখিক পরীক্ষা হয়ে গেছে।
কিন্তু শেষের দিকে তিনি আটকে গেছেন। তার মৌখিক পরীক্ষা স্থগিত রয়েছে।
সিরাজুল ইসলাম মুন গনমাধ্যমকে বলেন, ‘তিন বিসিএসে চেষ্টার পর এবারই প্রথম ভাইভা পর্যন্ত এসেছি। দৃঢ় বিশ্বাস যে আমি এবার চাকরি পাবো। ক্যাডারে না হলেও নন-ক্যাডারে একটা চাকরি জুটবে বলে আশায় আছি। কয়েক দফায় মৌখিক পরীক্ষা স্থগিতে এখন হতাশা কাজ করছে। পরিবারও হতাশ। বাবা-মা আশাহত হচ্ছেন। সব সময় নানা সংশয়ের কথা বলছেন। সব ধাপ পেরিয়ে শেষে এসে এমন ঝুলে থাকাটা অসহনীয়।’
পিএসসির চেয়ারম্যান ও সদস্য কারা
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মো. সোহরাব হোসাইন বর্তমানে পিএসসি’র চেয়ারম্যান।
সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এস. এম. গোলাম ফারুক, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহম্মদ।
অন্য সদস্যরা হলেন, নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) জাহিদুর রশিদ, ঢাবির আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুবিনা খোন্দকার, কে এম আলী আজম ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, মো. খলিলুর রহমান ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সাবেক সচিব, মো. মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী সাবেক ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক সচিব হেলালুদ্দিন আহমদ, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করা ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম, আরেক সদস্য অধ্যাপক ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
পদত্যাগে প্রস্তুত চেয়ারম্যান ও সদস্যরা
সরকার যদি পদত্যাগ করতে বলে, সঙ্গে সঙ্গে তা করতে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন পিএসসির চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান খোদ পদত্যাগে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন। তিনজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেও একই তথ্য পাওয়া গেছে। তারাসহ অন্য সদস্যরা সরকারের নির্দেশনা পেলে পদত্যাগ করে সরে যেতে চান।
পিএসসির তুলনামূলক নবাগত একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করে গনমাধ্যমকে বলেন, ‘পিএসসি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। দল ও মতাদর্শের প্রতি বিশ্বাস-অবিশ্বাস ঝেড়ে ফেলে এখানে দায়িত্ব নিতে হয়। তারপরও দলীয় বা মতাদর্শগত ট্যাগ প্রত্যেকের সঙ্গে লাগানো থাকেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের নিয়োগ দিয়েছিল, সেজন্য আমাদের সঙ্গে কাজ করতে অনেকে বিব্রত হতে পারেন। আবার আমাদের যারা এখন সদস্য, তারাও অনেকে বিব্রত বোধ করছেন। সব মিলিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা সরে যাবো।’
দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ সরকারের শিক্ষা প্রশাসনে কাজ করে আসা একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করে গনমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের সরে যাওয়াটাই ভালো বোধকরি। এটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সেটাও আবার মনে রাখতে হচ্ছে। এখানে একযোগে সবাই পদত্যাগ করলে তো শূন্যতার সৃষ্টি হবে। তখনো আবার ক্যু করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলবে। সেজন্য সবাই নামমাত্র দায়িত্বে আছেন। পদত্যাগ বা অপসারিত হতে পারেন, এমন মানসিকতা নিয়ে সবাই প্রস্তুত। বললেই সরে যাবো।’
জানতে চাইলে পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় গনমাধ্যমকে বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতি তো দেখছেনই। আমরা মূলত সরকারের নির্দেশনার দিকে চেয়ে আছি। যদি সরে যাওয়ার নির্দেশনা আসে, তাহলে সেভাবে… আর যদি থাকতে হয়, সেজন্যও প্রস্তুত আছি। আমরা কোনো দলের না। সরকার কাজ করতে বললে, নিয়ম মেনে করা হবে।’
সরকার তো কোনো বাধা দিচ্ছে না, তারপরও নিয়োগ পরীক্ষাগুলো কেন একের পর এক স্থগিত করা হচ্ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কিছু কারণ তো আছেই। অনেক সদস্যই তো ঝামেলায়। অনেক কমিটির কাজটা ঠিকঠাক হচ্ছে না। নানা রকম উত্তেজনা রয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় সেগুলো স্থগিত আছে। সরকার নির্দেশনা দিলে সেগুলোর কাজ সচল করা যাবে।’
বিষয়টি নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা কেউ এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তাদের মধ্যে দুজন কর্মকর্তা বিষয়টিকে (পিএসসিতে রদবদল আনা) ‘অতি স্পর্শকাতর’ বলেও জানান।