ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সূত্রপাত ঘটানো নেতারা রাজনৈতিক দল গঠনের পথে এগোচ্ছেন।
এর অংশ হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অক্টোবরে জেলায় জেলায় কমিটি গঠন করবে।
এরই মধ্যে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা করছে। খবর সমকাল
কাল মঙ্গলবার বিএনপির সঙ্গে তারা বসছে, পরে হবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বৈঠক।
যদিও জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়টি আনুষ্ঠানিক স্বীকার করেনি।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, তরুণ ও ছাত্র অভ্যুত্থানের এ দুই শক্তিকে সংগঠিত রাখার কাজ চলছে।
অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে রাজনৈতিকগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ঐক্য প্রতিষ্ঠা ধারাবাহিক বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য।
সংবিধান সংস্কার নাকি পুনর্লিখন করা প্রয়োজন– এ মতামত নেওয়া হচ্ছে। পুনর্লিখন হলে, তা কীভাবে করা যেতে পারে– এই ভাবনাও জানতে চাওয়া হচ্ছে।
ইতোমধ্যে এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে বৈঠক করেছে নাগরিক কমিটি। মাহমুদুর রহমান মান্নার অসুস্থতার কারণে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠক পিছিয়ে গেছে।
বৈঠকের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরিচিতিমূলক সভা হচ্ছে। পরে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে।’
কী আলোচনা হচ্ছে– প্রশ্নে নাসীরুদ্দীন বলেন, আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হলে গণমাধ্যমকে জানানো হবে।
তবে আগে যেসব বৈঠক হয়েছে সেগুলোর সূত্র গনমাধ্যমকে জানিয়েছে, নাগরিক কমিটি আগামী নির্বাচন এবং তাতে জোটের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছে।
শিল্প খাতে এবং পাহাড়ে সাম্প্রতিক অস্থিরতা নিরসনে তারা কী ভূমিকা রেখেছে, তা নিয়েও কথা হয়েছে।
এতে একটি দল প্রশ্ন তুলেছিল, নাগরিক কমিটি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের অংশ, নাকি সরকারি দল?
নিজেদের সরকারি দল হিসেবে না মানলেও সরকারের সংস্কার কর্মসূচির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে নেন নাগরিক কমিটির নেতারা।
এই প্ল্যাটফর্ম থেকে রাজনৈতিক দল গঠিত হলে নির্বাচনী জোট হতে পারে কিনা– এ প্রশ্নও বৈঠকে রাখেন কমিটির নেতারা।
কমিটির এক সদস্য গনমাধ্যমকে বলেন, জাতীয় নাগরিক কমিটি কখনও রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হবে না।
তবে সব অভ্যুত্থানের পর নতুন রাজনৈতিক বা রাজনৈতিক দর্শনের জন্ম হয়। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান থেকেও তেমনটি হবে।
এজন্য পরিস্থিতি যাচাই করা হচ্ছে। তবে বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচনী রাজনীতি সহজ নয়।
ভোটের মাঠে সক্রিয় দলের মধ্যে বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে বৈরিতা সৃষ্টি হলে তা অভ্যুত্থানের লক্ষ্য অর্জনে বাধা সৃষ্টি করবে।
আরেক সদস্য জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলো কী কী করবে না, এমন প্রতিশ্রুতি চায় নাগরিক কমিটি।
তা দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বলা হচ্ছে। অভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর বৈঠক থেকে বিরোধে না জড়ানো, মারামারি থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি এসেছিল।
তবে তা রক্ষা করা হয়নি। অভ্যুত্থানে কার কত বড় অবদান, তা নিয়ে বিরোধে না জড়ানোও বৈঠকের উদ্দেশ্য।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। সরকারি হিসাবে ৭ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন জুলাই গণহত্যায়।
বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা ১ হাজার ৫৮১। আহত হয়েছেন ৩১ হাজার আন্দোলনকারী।
বিএনপি, জামায়াতসহ যেসব দল ২০১০ থেকে শেখ হাসিনার বিরোধী আন্দোলন করছে, তাদের নেতাকর্মীর সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ছিল অভ্যুত্থানে।
যদিও সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ১ জুলাই আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল।
শেখ হাসিনার পতনের পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয়ে বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, দখলসহ নানা অপকর্ম হচ্ছে।
তা ঠেকাতে বিভিন্ন জেলায় মতবিনিময় সভা করেছেন প্রকৃত সমন্বয়করা। একে স্থায়ী রূপ দিতে জেলা ও উপজেলায় কমিটি করা হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
সরকারের কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করার ‘প্রেসার গ্রুপ’ হিসেবে কাজ করতে জাতীয়ভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে ১০১ সদস্যের কমিটি গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে।
একাধিক সমন্বয়ক গনমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
তাদের ভাষ্য, অরাজক পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে স্থিতিশীল পরিবেশ না আসা পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাখবেন তারা।
গণঅভ্যুত্থানের চেতনা রক্ষা, স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করবে জেলা কমিটিগুলো।
সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেন, ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত দলমত নির্বিশেষে সবাই আন্দোলনে চলে আসছে, কোনো ঝামেলা হয়নি।
আন্দোলন ইনক্লুসিভ ছিল, ছাত্রদল, শিবির আসছে; ছাত্রলীগ থেকেও অনেকে আসছে; সাধারণ জনতা আসছে।
তবে ৫ আগস্টের পর থেকে স্বাভাবিকভাবেই পরিস্থিতি ভিন্ন হয়েছে। যার যার মতাদর্শ অনুযায়ী কাজ করা শুরু করেছে।
এ কারণে আলাদা আলাদা গ্রুপ হয়ে গেছে। ছাত্রদল, শিবির আলাদা গ্রুপ করেছে। অনেকে অপকর্মে জড়াচ্ছে; কিন্তু তারা সমন্বয়ক নামধারী।
সাংগঠনিক পরিচয় থাকলেও নাম হয় অমুক সমন্বয়ক চাঁদাবাজি করছে, মারছে ইত্যাদি।
সব কমিটি ভেঙে দিয়ে লাভ হচ্ছে না। আবার কমিটি না থাকায় সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না।
তাই জেলাভিত্তিক বা উপজেলাভিত্তিক কমিটি দেওয়ার কথা ভাবছি।
‘সমন্বয়ক’ নামের বিতর্ক ঠেকাতে এই নামে কোনো পদ থাকবে না কমিটিতে। আহ্বায়ক, সদস্য সচিব পদ থাকবে কমিটিতে।
আব্দুল কাদেরের ভাষ্য, রাজনৈতিক দলে পরিণত হবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এটা যতদিন থাকবে, জাতীয় প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই থাকবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম বলেন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি হবে। অনেক ভুয়া সমন্বয়ক বের হচ্ছে। অনুমোদিত থাকলে, শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে।
এই ছাত্রনেতা জানিয়েছেন, ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ কমিটিতে থাকতে পারবে না। ছাত্রদল বা শিবিরের কেউ কমিটিতে এলে, আগের ছাত্র সংগঠন ছেড়ে আসতে হবে।
আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, একটি কেন্দ্রীয় কমিটি দেওয়ার কথা ভাবছি।
সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, মতবিনিময় সভার উদ্দেশ্য ছিল মানুষের কথা শোনা এবং আহত ও শহীদ পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ।
মানুষকে সংগঠিত করা এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কাজ করবে।
জেলা ও উপজেলায় কমিটির ব্যাপারে এখনও আলোচনা চলছে।
আসছে ‘লংটাইম’ কর্মসূচি
রাষ্ট্র পুনর্গঠনে ‘লংটাইম’ কর্মসূচি নিয়ে আসছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
আবু বাকের মজুমদার বলেন, পুনর্গঠনের আলাপের জন্য রূপরেখা দেওয়া হবে। কর্মসূচি মাঠে থাকবে, পাশাপাশি সেমিনার হবে, মতবিনিময় সভা হবে।
আমরা প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর জন্য কিছু প্রস্তাব দেব। সে জন্য কর্মসূচি হবে।
এখনও ফ্যাসিবাদের দোসররা প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আছে, তাদের রেখে কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গঠন সম্ভব নয়।
মতবিনিময় সভার অর্থায়ন যেভাবে
আবু বাকের মজুমদার বলেন, মতবিনিময় সভায় যারা যাচ্ছে, সবাই শিক্ষার্থী।
তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে বা স্থানীয় প্রতিনিধিদের বাসায় থাকে। ফলে খরচ খুব একটা নেই। যাতায়াতের জন্য ক্রাউড ফান্ডিং, আবার কিছু সহযোগিতা রয়েছে।
সহযোগিতা কারা করছে– প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘নামটা জানি না।
কয়েকটা গাড়ির খরচ বহন করছে; ওদের গাড়িটা দিছে। যেমন অভ্যুত্থানের সময় মানুষ মাইক দিয়ে, পানি দিয়ে সহযোগিতা করেছে, অনেকটা সেই রকম।’
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত ৮ জুলাই ৫৮ সদস্যের কমিটি করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম তখন বলেছিলেন, কোটা সংস্কার হলে কমিটি থাকবে না।
সরকার পতনের দু’দিন আগে ৩ আগস্ট কমিটিকে ১৫৮ সদস্যে বর্ধিত করা হয়। অভ্যুত্থানের পর ড. ইউনূস সরকারে এই কমিটির দু’জন মন্ত্রী মর্যাদায় উপদেষ্টা হয়েছেন।