ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে এক ব্যাংকে ১৪৫ জনের চাকরি!


মীর মোহাম্মদ শাহীন। কর্মসংস্থান ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার। ২০১১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সিনিয়র অফিসার হিসেবে ব্যাংকটিতে নিয়োগ পান তিনি। পেরিয়ে গেছে ১৪ বছর। এর মধ্যে একাধিকবার পদোন্নতিও পেয়েছেন। বেতন—ভাতাও বেড়েছে। নিজের পছন্দমতো ব্রাঞ্চে চাকরি করছেন শাহীন। নানা সুযোগ—সুবিধা আরও কতো কি! তবে সম্প্রতি শাহীনের ঠকবাজি ধরা পড়ে যায়। মানবজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে শাহীনের নিয়োগ
প্রক্রিয়ায় ভয়াবহ জালিয়াতির তথ্য। কাগজপত্র বলছে, নিয়োগের সময় শাহীন তার পিতা মীর মোশারফ হোসেনের যে মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করেছেন তা আসলে নকল। গেজেট নম্বরও ভুয়া। এমনকি শাহীনের পিতার নামে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলায় কোনো মুক্তিযোদ্ধাই নেই। উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত তালিকায়ও শাহীনের পিতার নাম পাওয়া যায়নি। ভয়ঙ্কর তথ্য হলো শাহীনের পৈতৃক নিবাস জয়নাবাড়ী গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দারাও জানেন না শাহীনের বাবা মীর মোশারফ হোসেন কবে, কোথায় মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। শাহীন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছে— এই কথা শুনে তারা রীতিমতো অবাক। তাহলে কীভাবে কোটায় চাকরি পেলেন শাহীন? কাদের যোগসাজশে জালিয়াতি করে ১৪ বছর চাকরি করছেন। নিয়োগ বোর্ড তাকে কীভাবে নিয়োগ দিলেন। এই প্রশ্নের জবাব মিলছে না। তবে মানবজমিন অনুসন্ধানে কর্মসংস্থান ব্যাংকের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আরও তেলেসমাতি কাণ্ড বেরিয়ে এসেছে। অনুসন্ধান বলছে, শুধুমাত্র মীর মোহাম্মদ শাহীন একাই নয়, ২০১১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া গেজেট নম্বর বসিয়ে ব্যাংকটিতে অন্তত ১৪৫ জন চাকরি নিয়েছেন। সকলেই বহাল তবিয়তে আছেন। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে নিয়োগ পাওয়াদের কেউ কেউ এখন সহকারী মহাব্যবস্থাপক, সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, প্রিন্সিপাল অফিসার, সিনিয়র অফিসার, অফিসার, সহকারী অফিসার ও ডাটা এন্ট্রি অফিসার পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। কেউ কেউ ২ থেকে ৩ বারও পদোন্নতি পেয়েছেন। অনেকে পছন্দমতো নিজ জেলায় চাকরি করছেন। সুযোগ—সুবিধা পাচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝড়ের বেগে দ্রুত পদোন্নতি পাওয়া অনেকে কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট কিনেছেন। আলিশান জীবন পার করছেন। বিদেশ ভ্রমণ করছেন। এমন অন্তত ৬০ জনের বর্তমান কর্মস্থল, পদোন্নতির তথ্য, রাজনৈতিক পরিচয়, স্থায়ী ঠিকানা ও বিপুল সম্পদ অর্জনের তথ্য মানবজমিনের হাতে রয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ পাওয়াদের অধিকাংশই ছাত্র জীবনে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কেউ সরাসরি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পদধারী ছিলেন। কারও কারও পিতা—মাতাও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। মানবজমিনের হাতে থাকা ভুয়া সনদে নিয়োগ পাওয়াদের তালিকা ধরে অন্তত ৩০ জনকে ফোন করা হয়। ফোনে কীভাবে নিয়োগ পেয়েছেন প্রশ্ন করা হলে কেউ জবাব দিতে পারেননি। কেউ বলেছেন কোটায় নিয়োগ পাননি। আবার কেউ বলেছেন কিসে নিয়োগ পেয়েছে, তা মনে করতে পারছেন না। অনেকে বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পেয়েছি। গেজেট নম্বর জানি না। তবে এই প্রতিবেদককে কেউই তাদের পিতার মুক্তিযোদ্ধা সনদের প্রমাণপত্র দেখাতে পারেননি। কয়েকজন বলেছেন, নিয়োগের সময় তাদের বাবার সনদ ছিল না। কিন্তু পরে হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বলছে, কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে পাঠানো ১৪৭ জনের তালিকার মাত্র দু’জনের গেজেট নম্বর পাওয়া গেছে। তাও কিছুটা গরমিল। বাকি সবগুলো নকল গেজেট নম্বর। ওই গেজেট নম্বরের কোনো মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নেই। অনেকভাবে তল্লাশি করা হয়েছে। কিছু পাওয়া যায়নি। সামরিক, বেসামরিক, লালমুক্তি বার্তা, ভারতীয় তালিকায় কোথাও তাদের নাম পাওয়া যায়নি। নিয়োগের সময় একটি ভুয়া গেজেট নম্বর বসিয়ে তাদের চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে ধারণা করছে মন্ত্রণালয়। এদিকে মানবজমিনের হাতে আসা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি পাওয়া ১৪৫ জনের তালিকা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হয়। মন্ত্রণালয় তা যাচাই বাছাই করে ভুয়া বলে শনাক্ত করেন। কারও পিতার মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও ন্যূনতম প্রমাণ মন্ত্রণালয়ে পাননি। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, কোটায় নিয়োগ পাওয়াদের তালিকা কর্মসংস্থান ব্যাংকে চেয়েছি। পরে ব্যাংক থেকে একটি তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই তালিকায় চাকরি পাওয়া প্রত্যেকের নামের সঙ্গে তাদের পিতার মুক্তিযোদ্ধা সনদের গেজেট নম্বর ও নিয়োগের তারিখ দেয়া রয়েছে। তবে আমরা ওই নম্বরে কোনো মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে পাইনি। এমনকি তাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ, সামরিক, বেসামরিক গেজেট, লালমুক্তি বার্তা, ভারতীয় তালিকা, এমআইএস নম্বর কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি। গেজেট নম্বরগুলো আসলে নকল ও ভুয়া। তারা যে মুক্তিযোদ্ধা এমন কোনো কাগজপত্র ও দালিলিক প্রমাণপত্র আমাদের মন্ত্রণালয়ে ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদে খুঁজে পাইনি। পরে আমরা এই ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কর্মসংস্থান ব্যাংকে সুপারিশ করেছি। এখন প্রতারণার সঙ্গে জড়িতদের কারও চাকরি থাকার কথা নয়। তাদের চাকরিতে নিয়োগের সার্টিফিকেটই যদি ভুয়া থাকে, তাহলে কীভাবে চাকরি থাকবে?

ভুয়া গেজেট নম্বরে যারা নিয়োগ পেয়েছেন: চাকরিতে নিয়োগের সময় সিনিয়র অফিসার, অফিসার, সহকারী অফিসার ও ডাটা এন্ট্রি অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া প্রত্যেকেই পদোন্নতি পেয়ে এখন সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার (এসপিও) হিসেবে কর্মরত আছেন। তারা হলেন— রাসেল আহমেদ, মামুনুর রশীদ, খালেদ সাইফুল্লাহ, বাসুদেব মণ্ডল, সালমা রহমত, মুহাম্মদ শরিফুল ইসলাম, সেলিম রেজা, ইমতিয়াজ হায়াত খান, মীর মোহাম্মদ শাহীন, মোবারক হোসেন, সাঈমা হাশেম, মোহাম্মদ মোরশেদ মিয়া, এসএম সেলিম রেজা, সরকার মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক, একেএম রেজাউল কবীর খান, নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, আরজুমান আরা, রাশেদা বেগম, মোহাম্মদ মহিউদ্দিন রাসেল, মোসাম্মৎ শিউলী সুলতানা, খন্দকার মোবাশ্বের হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, রাসেল সরকার, শেখ মুঞ্জীল আলী, মোহাম্মদ মাহমুদুল হক খান, নুরুজ্জামান মিয়া, শাহনেওয়াজ হক, ফেরদৌসী সুলতানা, আশরাফুল ইসলাম, মাহফুজা আখতার, কাজী লাইলুম মুনীরা, সাইফুল ইসলাম, মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিন, মাহমুদা আক্তার, সুব্রুত মজুমদার, এনামুল হক, মোহাম্মদ কামরুল হাসান, মোহাম্মদ ইব্রাহিম মজুমদার, আমির হোসেন মোল্লা, আলী আক্কাছ মিজি, সৈয়দা সোহেলী পারভীন, মোশাররফ হোসেন, খলিফা কামরুল হাসান, কাজী গোলাম শোয়েব, আতিকুর রহমান খোশনবীশ, মতিউর রহমান, আনিসুর রহমান, কবির হোসেন, ঝর্ণা রায়, সাবরিনা মমতাজ সাবিনা, নাজিয়া জাফরিন, এস এম সফিউল আজম, সজল কুমার মণ্ডল, রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ আমিন খালিদ চকদার, বিদ্যুৎ কুমার সরকার, পল্লব কুমার সেন, মৃদুলেন্দু বড়াল, মোহাম্মদ মাসুদ, মোহাম্মদ আবদুল রহমান, এ বি সালেহীন, মৌসুমী ইসলাম সুমী, মাহবুব আলম, শাহরিয়ার রুবেল, হাফিজুর রহমান, মীর মো. রবিউল আলম, সেলিম রেজা, মোহাম্মদ বদরুল আলম, রেজাউল আলম, এসএম নুরুদ্দিন, মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন, মাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন, আব্দুস সালাম, মুনতাসির নাজিম দোলন, মো. নাদিম, আব্দুল্লাহ আল হাদী, এটিএম নাজমুস সাকলাইন, আজিজুর রহমান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ইসমেতারা ইসলাম রিমি, মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, আসকে নবী ফাজলে রাব্বী, মোহাম্মদ মাসকুর রহমান, এএসএম মুশফিকুর রহমান, ফয়সাল আহমেদ, সাইদুল ইসলাম, মুহাম্মদ আল আমিন, নাছরিন আক্তার, বিপিন মজুমদার, সেকেন্দার আলী, গোলাম ওয়াদুদ, খন্দকার মেহেদী হাসান, জাকির হোসেন, রাশিদুল ইসলাম, মনজুর রহমান, ফারহানা ইয়াছমিন, রাশিদুল আলম, মোহাম্মদ জান্নাতুল হাসান, আবুল হোসেন, রাসেলুজ্জামান, সোনিয়া রহমান, লায়লা আখন্দ রিয়ান, মাজহারুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির ও সোহানুর রহমান। তবে ভুয়া সনদে চতুর্থ শ্রেণিতে নিয়োগ পাওয়া ৩৮ জন এমএলএসএস ও নিরাপত্তা প্রহরী কেউই এখনো পদোন্নতি পাননি। এদের মধ্যে কেউ কেউ চাকরিতে থেকেই উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন।
জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ভুয়া সনদে নিয়োগ পাওয়া কর্মসংস্থান ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মীর মোহাম্মদ শাহীন মানবজমিনকে বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পেয়েছি। সকল কাগজপত্র ব্যাংকে জমা আছে। পিতার বেসামরিক গেজেট নম্বর ও এমআইএস নম্বর কতো জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমার এসব জানা নেই। তাদের কাছে কোনো সনদপত্র নেই বলে জানান তিনি। তার পিতার মুক্তিযোদ্ধা সনদ আছে কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বাড়িতে গিয়ে খুঁজে দেখতে হবে। পরে তিনি কোটায় নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন।

ভুয়া সনদে চাকরি নেয়া কর্মসংস্থান ব্যাংকের আরেক সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার শাহনেওয়াজ খান বলেন, আমি কোটায় নিয়োগ পেয়েছি। নাকি সাধারণ নিয়োগ হয়েছে তা মনে করতে পারছি না। তবে আমার পিতার মুক্তিযোদ্ধা সনদ আছে। তাহলে মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম নেই কেন জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমি চাকরি পাওয়ার পরে আমার বাবার সনদ হয়েছে। পরে উপজেলা তালিকায় নাম না থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

ইমতিয়াজ হায়াত খান নামের আরেক প্রিন্সিপাল অফিসার মানবজমিনকে বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পাইনি। আমার পিতা মুক্তিযোদ্ধা নয়। পরে ব্যাংক থেকে পাঠানো তালিকায় কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এমন হওয়ার কথা নয়। ব্যাংক হয়তো ভুল করেছে।
জানতে চাওয়া হলে কর্মসংস্থান ব্যাংকের উপ—মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এস এম এমাম মাসুম মানবজমিনকে বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকা চেয়েছিল। আমরা ইতিমধ্যে তালিকা পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন চাকরি পাওয়াদের কে আসল কে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি নিয়েছেন, তা আমাদের জানা নেই। যদি এমন কিছু হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মন্ত্রণালয় থেকে এখনো আমাদের কিছু জানানো হয়নি। মন্ত্রণালয় ক্লিয়ারেন্স দিলে আমাদের পরবর্তী প্রসিডিউর শুরু হবে। ১৪৭ জন ব্যক্তি কীভাবে ভুয়া গেজেট নম্বর দিয়ে চাকরি পেলো— এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে আমি নিয়োগ পেয়েছি ১ বছর হয়েছে। তাই কীভাবে কী হয়েছে তা আমি অবগত নই। আমি ঊর্ধ্বতনদের বিষয়টি জানাবো।

সূত্র- মানবজমিন

মতামত দিন