সংবিধান-প্রেসিডেন্ট ইস্যুতে বিএনপি’র সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বৈঠক

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকেই রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে তৎপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অংশ হিসেবে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করছে সংস্কারসহ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে। এরই মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনের দেয়া এক বক্তব্য ঘিরে উত্তপ্ত রাজনীতির মাঠ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র আন্দোলনের নেতারা প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবি করে আসছেন। যদিও প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এ ইস্যুতে অনেকটা নেতিবাচক। দলটির মতে সাংবিধানিক সংকট হয় এমন কোনো উদ্যোগ যাতে না নেয়া হয়।

এমন বাস্তবতায় প্রেসিডেন্টের অপসারণ ও সংবিধান ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। এরইমধ্যে এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সিরিজ বৈঠক শুরু করছে তারা। এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন নেতারা। প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবি ওঠার পর যমুনায় অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক সূত্র জানায়, ড. মো. ইউনূস বর্তমান প্রেসিডেন্টকে অপসারণ ইস্যুতে ছাত্রদের নমনীয় মত প্রত্যাশা করেন। এমনকি তিনি সাহাবুদ্দিনের এমন বক্তব্যের পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে কিনা সে বিষয়ে প্রয়োজনে তদন্ত করার কথাও জানান। এ ছাড়া সংবিধান ইস্যুতে ছাত্ররা ইতিমধ্যে সরকারকে নতুন সংবিধান রচনার পক্ষে মত দিয়েছে। প্রয়োজনে বর্তমান সংবিধান স্থগিতেরও পরামর্শ দেন। সম্প্রতি বাংলা একাডেমিতে এক আলোচনা সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, বর্তমান সংবিধানের অধীনে শপথ নেয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভুল ছিল। গতকাল বিএনপি’র সঙ্গে বৈঠক করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। বৈঠকে বর্তমান প্রেসিডেন্টকে কেন অপসারণ জরুরি সে বিষয়ে নিজেদের মত দিয়েছে ছাত্ররা। মির্জা ফখরুল ছাড়াও এই বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ও যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী।

প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের করার বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করলেও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি বিএনপি। দলীয় ফোরামে আলোচনা করে প্রেসিডেন্টকে অপসারণে দলের সিদ্ধান্ত কী হবে তা পরবর্তীতে জানাবে বিএনপি।

গতকাল রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির ৯ নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা।

বৈঠক শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আজকে মূলত তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি, প্রথম প্রসকেড রিপাবলিক অব প্রোক্লেমেশন, এটি আমরা কে কীভাবে ঘোষণা দেবো এবং কীভাবে করা যায় এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। দ্বিতীয় হলো: প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণ। তার অপসারণটা খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমরা কীভাবে করতে পারি এবং যেকোনো ধরনের সংকট কীভাবে দূর করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করেছি। তৃতীয় হলো: জাতীয় ঐক্য নিয়ে আলোচনা করেছি। তারা আমাদের কথা শুনেছেন। তারা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তারা তাদের ফোরামে কথা বলবেন।
তিনি বলেন, বিএনপি’র পাশাপাশি আমরা জামায়াতের সঙ্গে বসেছিলাম। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তাদের সঙ্গেও আমরা এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। জামায়াতের জায়গা থেকে তারা এ বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, ইতিমধ্যে তাদের জায়গা থেকে তারা তাদের বক্তব্যে স্পষ্ট করেছেন। নৈতিক জায়গা থেকে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনের তার পদে থাকার কোনো ধরনের গ্রহণযোগ্যতা নেই। ইসলামী আন্দোলনও একই কথা বলেছে। তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্টের অপসারণ চান।

হাসনাত বলেন, আমরা ২৩ তারিখে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলাম যে, সকল গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দল, যারা গণঅভ্যুত্থানে আমাদের নেতৃত্বে এসে, আমাদের ফ্যাসিবাদ বিলোপের প্রাথমিক ধাপ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন আমরা ঘটিয়েছি। এখন এই ফ্যাসিবাদ ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গ বিলোপের ক্ষেত্রে আমাদের যে আরেকটি বাধা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণ এবং আমাদের যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এসব বিষয়ে যারা আমাদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছে গত দু’দিন ধরে আমরা তাদের সঙ্গে আলাপ করছি।

তিনি জানান, রোববার গণতন্ত্র মঞ্চ, গণঅধিকার পরিষদ ও ১২ দলীয় জোটের সঙ্গে সংলাপ রয়েছে। এই রাজনৈতিক সংলাপ অব্যাহত থাকবে।

বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির ৯ জন অংশ নেন। তারা হলেন— বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, মুখপাত্র উমামা ফাতেমা, সদস্য সচিব আরিফ সোহেল, মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদ, সমন্বয়ক রিফাত রশিদ, জাতীয় নাগরিক কমিটি আহ্বায়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী, মুখপাত্র সামন্তা শারমিন, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, সদস্য আরিফুল ইসলাম আদিব।

অন্যদিকে শুক্রবার জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলটির সঙ্গে বৈঠক করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। বৈঠকে জামায়াতের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, নায়েবে আমীর ডা. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য হামিদুর রহমান আজাদ। বৈঠকে ছাত্রদের পক্ষে হাসনাত আবদুল্লাহ, আরিফ সোহেল, আবদুল হান্নান মাসউদ, উমামা ফাতেমা, নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী, আখতার হোসেন, সামান্তা শারমিন উপস্থিত ছিলেন। এ সময় ছাত্ররা প্রেসিডেন্টকে কেন অপসারণ জরুরি সে বিষয়ে নিজেদের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। জামায়াত নেতারাও ছাত্রদের দাবির পক্ষে নিজেদের নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা জানান। তবে সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐক্যের পক্ষে জোর দিয়েছে দলটি। এছাড়া সংবিধান ইস্যুতেও দলটি ছাত্রদের পক্ষে। জামায়াতের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, তারা প্রেসিডেন্টের অপসারণ ও নতুন সংবিধান রচনার পক্ষে। তাই ছাত্রদের মৌলিক দাবির সঙ্গে তাদের কোনো বিরোধ নেই। প্রেসিডেন্ট ইস্যু ছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় গুরুত্ব পায় ছাত্রদের দুই প্ল্যাটফর্মের যৌথ পাঁচ দফা। এদিকে প্রেসিডেন্ট পদ নিয়ে যখন আলোচনা তুঙ্গে তখন গত মঙ্গলবার বিএনপি’র শীর্ষ তিন নেতা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে জানানো হয়, সাহাবুদ্দিনকে সরানো হলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হতে পারে। যেটি দলটি চায় না।

গতকাল রাজধানীতে এক সমাবেশে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, সংবিধান সংশোধন নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই করতে হবে। জুলাই—আগস্টে ছাত্র—জনতার অভ্যুত্থানে ‘ফ্যাসিবাদের’ পতন হলেও ‘গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ ও ‘জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার’ আকাঙ্ক্ষা রয়ে গেছে। এমনভাবে সেই গণতন্ত্র ‘পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ করা, যাতে করে সেই গণতন্ত্র কেউ জনগণের বিপক্ষে কাজে না লাগাতে পারে। প্রকৃত গণতন্ত্র, জনগণের গণতন্ত্র, সে রকম একটা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে যে সংস্কার যেখানে করা দরকার, যত দ্রুত সেটা করে বাংলাদেশে জনগণের নির্বাচিত শাসন, নির্বাচিত সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠাই এখন সময়ের দাবি। নির্বাচিত সরকারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, এটা যত দেরি হবে তত নতুন নতুন সংগঠন গজাবে, নতুন নতুন ব্যক্তি আসবে; তারা নতুন নতুন প্রস্তাব নিয়ে আসবে, নতুন নতুন আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত করার চেষ্টা করবে এবং বোঝানোর চেষ্টা হবে যে, এটাই জনগণের আকাঙ্ক্ষা। এটা সঠিক হবে না। নির্বাচিত সরকার ছাড়া কারও পক্ষে জনগণের আকাঙ্ক্ষার কথা বলার সুযোগ নেই।
একই সভায় নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এটা অদ্ভুত সরকার। এই সরকার এখন নিজেই বুঝতে পারছে না তারা বিপ্লবী সরকার না কি সাংবিধানিক সরকার। আবার কেউ কেউ বলছেন ‘বিপ্লব যে অসম্পূর্ণ ছিল, সেই ‘অসম্পূর্ণ’ বিপ্লব এবারে আমরা সম্পূর্ণ করবো’। এজন্য আবার দফা—দফা পেশ করেছেন। সেই দফার মধ্যে সমাজে গুণগত পরিবর্তন করার মতো এমন কিছু নাই।

গত ২৩শে অক্টোবর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, যারা গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে, তারা ৭২—এর সংবিধানের পক্ষে থাকতে পারে না। ৭২—এর সংবিধান ছুড়ে ফেলে নতুন সংবিধান লিখতে হবে। তিনি বলেন, ৩রা আগস্ট আমরা শহীদ মিনার থেকেই একদফা ঘোষণা দিয়েছিলাম। এই একদফার মধ্যে ছিল ফ্যাসিবাদ ব্যবস্থা বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। ফ্যাসিবাদ ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গভাবে বিলোপের যে প্রশ্ন, সেটির কিন্তু এখনো সমাধান হয়নি। যারা একদফা দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিল, যারা গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে, তারা কখনো ৭২—এর সংবিধানের পক্ষে থাকতে পারে না। কারণ ৭২—এর সংবিধানের মধ্য দিয়েই আমাদের এ ফ্যাসিবাদ কাঠামো সবসময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হাসনাত বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার দোহাই দিয়ে চুপ্পুকে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন দেখতে চাচ্ছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কাছে আহ্বান থাকবে, ৭২—এর সংবিধানের পক্ষে এবং গণঅভ্যুত্থানের প্রশ্নে আপনাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। আপনাদের অবস্থান স্পষ্ট করা জরুরি। তিনি বলেন, একাত্তরের পর যে সংবিধানটি রচিত হয়েছিল, সেটি মূলত আওয়ামী সংবিধান। বাকশালীদের সংবিধান গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে আর প্রাসঙ্গিক নয়। আমরা গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য চাচ্ছি। এ ঐক্যের মধ্য দিয়েই আমরা ৭২—এর সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিয়ে নতুন করে সংবিধান লিখবো। নতুন সংবিধানে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হবে।
সূত্র-মানবজমিন

মতামত দিন