প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন—এর পদত্যাগ দাবিতে গতকাল দিনভর বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন। বঙ্গভবনের পাশে বিক্ষোভ করে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ। প্রেসিডেন্টের পদত্যাগসহ ৫ দফা দাবি জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গণজমায়েত থেকে এই দাবি জানানো হয়। বিকাল সাড়ে তিনটা থেকে শহীদ মিনারে শুরু হয় এই গণজমায়েত কর্মসূচি।
বিকাল পৌনে চারটার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহসহ কেন্দ্রীয় সমন্বয়করা গণ—জমায়েত কর্মসূচিতে যোগ দেন। এ সময় বক্তব্য রাখেন সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, সাহাবুদ্দিন চুপ্পু মসনদে বসে এখনও ফ্যাসিবাদের চর্চা করে যাচ্ছেন। তার পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। আমাদের বিপ্লব শেষ হয় নাই। আমরা হাসিনাকে হটিয়েছি, কিন্তু রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করতে পারি নাই। যতদিন পর্যন্ত ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে সুস্থ ও গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারছি ততদিন এই আন্দোলন চলবে।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ২৪ এর বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিক হবে কি না, তার ফয়সালা ১৭ই জুলাই হয়ে গেছে। যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ—যুবলীগের সন্ত্রাসীরা নগ্নভাবে হামলা চালিয়েছিল, সেদিনই সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে এই জঙ্গি সংগঠন এবং তাদের নেতা শেখ হাসিনার ঠাঁই বাংলার মাটিতে হবে না। রাস্তায় রক্ত দিয়ে আমরা সেটিকে নিশ্চিত করেছি। আমরা এই সপ্তাহের মধ্যে নিশ্চিত করতে চাই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ মুজিববাদী যত সংগঠন রয়েছে সবকিছু বাংলার মাটি থেকে উৎখাত হয়ে যাবে। তিনি উপদেষ্টাদের উদ্দেশ্যে বলেন, মুজিবের ছবি না লাগিয়ে নিহত ছাত্রদের ছবি লাগান। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ৫ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন হাসনাত।
দাবিগুলো হলো—
১. অবিলম্বে ৭২ এর সংবিধান যা চুপ্পুকে এখনো পদে আসীন থাকার সুযোগ করে দিয়েছে, সেটি বাতিল করতে হবে এবং সেই ’২৪ এর গণঅভ্যুত্থান প্রেক্ষাপটে নতুন করে সংবিধান রচনা করতে হবে।
২. এই সপ্তাহে ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে বাংলার মাটি থেকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে।
৩. ফ্যাসিবাদী সংবিধানের দোসর চুপ্পুকে এই সপ্তাহের মধ্যে অপসারণ করতে হবে।
৪. ’২৪—এর গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের আলোকে এই সপ্তাহের মধ্যে ‘প্রোক্লেমশান অব রিপাবলিক’— ঘোষণা করতে হবে এবং সেটি ও ক্রিয়াশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর মতের ভিত্তিতে ’২৪ পরবর্তী বাংলাদেশ পরিচালিত করতে হবে
৫. ১৪, ১৮, ২৪ সালের বিতর্কিত তিন নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করতে হবে, এই তিন নির্বাচনে যারা বিজয়ী সংসদ সদস্য ছিলেন তাদের সম্পদ বাতিল করতে হবে, তারা যাতে ’২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে কোনোভাবে প্রাসঙ্গিক না হতে পারেন সে ব্যবস্থা করতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আয়োজনে গণজমায়েতে বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম, আব্দুল হান্নান মাসুদসহ কেন্দ্রীয় সমন্বয়করা।
গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ। সন্ধ্যার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীরা। সেখান থেকে প্রেসিডেন্টের দ্রুত পদত্যাগের দাবি জানানো হয়। সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে প্রেসিডেন্টের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।
সমাবেশে ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, শেখ হাসিনার পলাতক হওয়ার পরই প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনকে সরিয়ে দিতে বলেছিলাম আমরা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম, গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট ধরে রাখতে একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করা যেতে পারে। কিন্তু তারা প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে শপথ গ্রহণ করার মাধ্যমে যে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটির খেসারত এখন দিতে হচ্ছে।
আওয়ামী লীগসহ তার সব অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধের দাবি তুলে তিনি আরও বলেন, আমরা আল্টিমেটাম দিচ্ছি আগামীকালকের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। একইসঙ্গে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনকে পদত্যাগ করতে হবে। সেটি না হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গভবন অভিমুখী লং মার্চ করবো
২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম: ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণের আল্টিমেটাম দিয়ে বঙ্গভবন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করছে ছাত্র—জনতা। মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৪টায় বঙ্গভবনের সামনে থেকে এই ঘোষণা দেয়া হয়। আন্দোলনকারীরা জানান, বর্তমান প্রেসিডেন্ট আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার দোসর। আমরা চাই না তিনি প্রেসিডেন্ট পদে থাকুন। তাই আমরা তাকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছি তিনি যেন প্রেসিডেন্টের পথ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি যদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ না করেন তাহলে আমরা জানি তাকে কীভাবে পদ থেকে সরাতে হয়। ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটামে কাজ না হলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিজে আহত হয়েছেন জানিয়ে বাহার উদ্দিন নামে একজন বলেন, প্রেসিডেন্ট চুপ্পু যে পর্যন্ত তার পদ থেকে পদত্যাগ না করবেন সে পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছেড়ে যাবো না। তিনি স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসর। আমরা চাই না কোনো স্বৈরাচারের দোসর এই পদে থাকুক।
মো. সোহাগ নামে একজন বলেন, আমরা দেখতে চাই চুপ্পু কতোদিন বঙ্গভবনে থাকতে পারেন। ছাত্র আন্দোলনে আহতরা পথে পথে আর দুর্নীতিবাজ ও স্বৈরাচারের দোসর প্রেসিডেন্ট চুপ্পু বঙ্গভবনে আরাম—আয়েশ করবে এটা মেনে নেয়া হবে না। ইনকিলাব মঞ্চের পক্ষ থেকেও বঙ্গভবনের পাশে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। তাদের কর্মসূচি থেকেও প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবি করা হয়।
ছাত্র—জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ই আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি পালিয়ে যাওয়ার পর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি।’ তবে সমপ্রতি মানজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট জানান, তিনি শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু তার কাছে এ সংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ বা নথিপত্র নেই। প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তিনি হয়তো সময় পাননি।’
বঙ্গভবনের নিরাপত্তা ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা: ওদিকে রাতে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ দাবিতে বঙ্গভবনের সামনের নিরাপত্তা ব্যারিকেড ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেন একদল বিক্ষোভকারী। এ সময় সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের বাধা দিতে দেখা যায়। রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময়ও বিক্ষোভকারীরা সেখানে অবস্থান করছিলেন।
দিনভর কর্মসূচি পালনের পর রাতে কিছু বিক্ষোভকারী হঠাৎ নিরাপত্তা ব্যারিকেড ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করেন। এ সময় আন্দোলনকারীদের বাধা দেয় নিরাপত্তায় নিয়োজিত সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। একপর্যায়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেন। পরে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিচার্জ করে এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।
সূত্র:মানবজমিন