বাংলাদেশে পেপাল থাকা কতটা জরুরি, চালু হতে বাধা কোথায়?

বাংলাদেশে পেওনিয়ার, জুম ও ব্যাংক ট্রান্সফার পদ্ধতি চালু রয়েছে। তবে এগুলো একটিও পেপালের মতো জনপ্রিয় নয়। একইসাথে কিছু কিছু মেথডে অতিরিক্ত ফি আদায়, অল্প সংখ্যক ফিচার থাকা কিংবা আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের কাছে সেগুলো গ্রহণযোগ্য না হওয়ার মতো সমস্যা রয়েছে।

বাংলাদেশে পেপাল চালু হতে বাধা কোথায়ঢাকার বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল মামুন একজন শিক্ষার্থী ও ফ্রিল্যান্সার। সম্প্রতি তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ভিত্তিক একটি অনলাইন সার্ভিস প্ল্যাটফর্ম উদ্বোধন করেছিলেন।

যেখানে জনপ্রিয় সব এআই টুল একসাথে কম দামে ব্যবহার করা যেত। প্রজেক্টটি সম্পন্ন করতে তার তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছিল।

তবে বিপত্তি বাধে তখনই, যখন মামুন তার প্ল্যাটফর্মটির জন্য পেমেন্ট গেইটওয়ে যুক্ত করতে যান। কেননা, বিশ্বে বহুল ব্যবহৃত পেমেন্ট সার্ভিস পেপাল বাংলাদেশ থেকে ব্যবহার করা যায় না।

মামুন যদিও প্ল্যাটফর্মটিতে অন্যান্য পেমেন্ট গেইটওয়ে যুক্ত করেছেন, তবে সেগুলোর একটিও পেপালের মতো জনপ্রিয় নয়।

সেক্ষেত্রে এই বিকল্পগুলো ব্যবহারকারীদের পেমেন্টকে আরও জটিল করে ফেলে।

এতে তারা অন্য প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়ে যান। উপায় না পেয়ে মামুন তার প্রজেক্ট থেকে সরে আসেন। এতে তার মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি হয়।

যদিও এটি সার্বজনীন সমস্যা নয়। বিশ্বের ২০০টিরও বেশি দেশে পেপাল চালু রয়েছে।

তবে বাংলাদেশে সেই সুযোগ নেই। বাংলাদেশ যেখানে অনলাইন কর্মীর দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে; সেখানে বিষয়টি বেশ অদ্ভুতই মনে হয়।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের ফ্রিল্যান্সিংয়ের শতকরা ১৪ ভাগই বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারদের দখলে।

পেপাল কেন দরকার?

আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের সাথে কাজ করা ফ্রিল্যান্সাররা প্রাথমিকভাবে দুটি উপায়ে কাজ করে থাকেন। প্রথমত, মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে আর দ্বিতীয়ত স্বাধীনভাবে।

এক্ষেত্রে কিছু মার্কেটপ্লেস একচেটিয়াভাবে পেপালের উপর নির্ভর করে। আর অন্যগুলো একাধিক পেমেন্ট পদ্ধতির প্রস্তাব করে।

মামুন বলেন, “আমরা বহু মার্কেটপ্লেস ব্যবহার করতে পারি না। শুধু আমাদের পেপাল সুবিধা নেই বলে।”

কিছু প্ল্যাটফর্ম শুধু পেপাল ব্যবহার করে।

এক্ষেত্রে একবার যখন আস্থা তৈরি হয়ে যায়, তখন বহু ফ্রিল্যান্সাররাই তার ক্লায়েন্টের সাথে মার্কেটপ্লেসের বাইরে কাজ শুরু করে।

এতে করে প্ল্যাটফর্ম ফি এড়িয়ে যাওয়া যায়। যাতে দুপক্ষই লাভবান হয়। কেননা, প্রতিটি পেমেন্ট থেকে মার্কেটপ্লেস মোটা অঙ্কের টাকা কেটে নেয়।

মামুন জানান, পশ্চিমা দেশগুলোর ক্লায়েন্টের জন্য পেপাল সবচেয়ে সুবিধাজনক পেমেন্ট পদ্ধতি।

কেননা, ওই দেশগুলোতে এটিই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। তারা প্রায়শই অন্য পেমেন্ট পদ্ধতির থেকে পেপালকে এগিয়ে রাখেন।

মীর তৌহিদুল ইসলাম নামের আরেক ফ্রিল্যান্সারও প্রায় একই অভিজ্ঞতার কথা জানান।

তিনি বলেন, “আমি একজন মার্কিন ক্লায়েন্টের পক্ষ থেকে ফুল টাইম রিমোট জবের প্রস্তাব পেয়েছিলাম।

তবে সেখানে একমাত্র পেমেন্ট অপশন ছিল পেপাল। যেহেতু আমি পেমেন্ট মেথডটি ব্যবহার করতে পারবো না; তাই আমাকে প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দিতে হয়।”

আমরা কি অন্য প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে পারি?

এ প্রসঙ্গে মামুন বলেন, “এক্ষেত্রে হ্যাঁ বা না দুটোই বলা যায়। পেপালের তুলনায় অন্য পেমেন্ট পদ্ধতিতে সাধারণত ট্রানজেকশন ফি বেশি। কিংবা এটি ক্লায়েন্টের জন্য সুবিধাজনক হয় না।”

বাংলাদেশে পেওনিয়ার, জুম ও ব্যাংক ট্রান্সফার পদ্ধতি চালু রয়েছে।

তবে এগুলো একটিও পেপালের মতো জনপ্রিয় নয়। একইসাথে কিছু কিছু মেথডে অতিরিক্ত ফি আদায়, অল্প সংখ্যক ফিচার থাকা কিংবা আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের কাছে সেগুলো গ্রহণযোগ্য না হওয়ার মতো সমস্যা রয়েছে।

তৌহিদ বলেন, আমি সাধারণত ডোমেইন কেনা ও বিক্রির কাজ করতাম। তবে পেপাল ব্যবহার না করতে পারার কারণে আমাদের অন্য পেমেন্ট মেথডের ওপর নির্ভর করতে হতো।

যেগুলো আমার আয়ের ৪০ ভাগ পর্যন্ত কেটে রেখে দিত। অথচ পেপাল ব্যবহার করতে পারলে মাত্র ৫ ভাগেরও কম আয় কাটা হতো বলে জানান তিনি।

এ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন টেকনোলজি ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর প্রফেসর বিএম মইনুল হোসাইন বলেন, “পেপালের মূল বিষয়টি হচ্ছে আস্থা।

যখন আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি আসে; তখন আস্থাই সব। পেপাল বিশ্বব্যাপী এমন জোড়ালো আস্থা অর্জন করেছে যে, মানুষজন অন্য পেমেন্ট মেথডের তুলনায় এটিকেই ব্যবহার করে থাকেন।”

এমন পরিস্থিতিতে ফ্রিল্যান্সারদের নিয়ে কাজ করা কিছু এজেন্সি আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের জন্য পেপালের ব্যবস্থা করে থাকেন। তবে সেটা ভিন্নভাবে।

তারা যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের একটি ঠিকানা ব্যবহার করে ব্যবসার নিবন্ধন করে। সেখানে একটি স্থানীয়ভাবে ব্যবসার লাইসেন্স নেন। সেই দেশের একটি ফোন নম্বরও রাখা হয়।

মামুন বলেন, “একবার এজেন্সিটি বিদেশে নিবন্ধিত হলে সেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের একটি ব্যবসা হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ করে। কিন্তু এখানে একটি খরচও আছে।

এক্ষেত্রে তাদের ওই দেশের সরকারকে ট্যাক্স ও ফি দিতে হয়৷ যেহেতু ফ্রিল্যান্সারদের পেপালে সরাসরি প্রবেশাধিকার নেই, তাই বাংলাদেশ মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে।”

বাধাগুলো কী?

বাংলাদেশে পেপাল ​চালুর বিষয়টি অনিশ্চিত। ফ্রিল্যান্সার ও ডিজিটাল উদ্যোক্তারা বিষয়টি নিয়ে হতাশ। যদিও কর্তৃপক্ষের কাছে এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যাখ্যা নেই।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের সাবেক প্রেসিডেন্ট সৈয়দ আলমাস কবির এই বিলম্বের পেছনে দুটি কারণ রয়েছে বলে মনে করেন।

তার মতে, পেপালের কাছে বাংলাদেশের আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ বেশ সামান্য মনে হয়। যাতে করে এখানে সার্ভিস চালুর ক্ষেত্রে তারা আগ্রহী নয়। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেশনের সাথে পেপালের পলিসির সামঞ্জস্য নেই।

কবির বর্তমানে মেট্রোনেট বাংলাদেশ লিমিটেডের সিইও ও আয়অল কর্পোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে রয়েছেন।

তিনি বলেন, “পেপাল দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে না এলেও ফ্রিল্যান্সাররা পেওনিয়ার ও জুম সার্ভিসের মাধ্যমে বহির্বিশ্বের কাজ করছে। তবে এই বিকল্পগুলো জটিলতা ও ফি বৃদ্ধির মতো সমস্যা তৈরি করছে।”

আরেকটি বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সাররা বৈধভাবে পেপাল অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন না।

অর্থাৎ, তারা বাংলাদেশ থেকে অন্য পেপাল ব্যবহারকারীদেরও পেমেন্ট পাঠাতে পারে না। এক্ষেত্রে অন্য দেশের ফ্রিল্যান্সারদের থেকে সার্ভিস নিতেও বেশ বিড়ম্বনা পোহাতে হয়।

কবির বলেন, “এখানে অর্থ পাচারের মতোও উদ্বেগ রয়েছে।”

বর্তমানে নীতিমালা অনুযায়ী বাংলাদেশের নাগরিকেরা প্রতি বছর সর্বোচ্চ ১২ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত বিদেশে পাঠাতে পারেন। যেটি আবার বাংলাদেশ ব্যাংক মনিটর করে।

এক্ষেত্রে এ পেমেন্টগুলো পেপালের মাধ্যমে করা হলে সেটি ট্র্যাক করা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সম্ভব হবে না। যাতে করে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।

বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ কী কী উদ্যোগ নিয়েছে?

২০১৭ সাল থেকে সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা দেশে পেপাল চালু সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।

তারা ফ্রিল্যান্সারদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, এটি শীঘ্রই চালু হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত বাস্তবে এক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

অধ্যাপক মাইনুল বলেছেন, “একাধিক ঘোষণা সত্ত্বেও আমার মনে হয় না যে, পেপালের সাথে আলোচনার জন্য কোন জোড়ালো চেষ্টা করা হয়েছে।”

সৈয়দ আলমাস কবিরও এই মন্তব্যের সাথে একমত পোষণ করেছেন।

তিনি বলেন, “সরকার ও পেপালের মধ্যে কোনও চুক্তি বা বৈঠক হয়নি, অন্তত আমার জানামতে।”

পেপালের জন্য বাংলাদেশের বাজার খুবই ছোট এমন ধারণার সাথে একমত নন অধ্যাপক মইনুল।

তিনি বলেন, “পেপাল ২০০টিরও বেশি দেশে কাজ করে। যার মধ্যে কয়েকটি বাংলাদেশের চেয়েও ছোট। তাদের যদি পেপাল ​​থাকতে পারে তবে আমরা কেন পারবো না?”

অধ্যাপক মইনুল অর্থ পাচারের আশঙ্কাও উড়িয়ে দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, “অন্যান্য দেশগুলিও একই রকম ঝুঁকি মোকাবিলা করে। আমাদের তাদের সমাধানগুলি সম্পর্কে জানতে হবে। সেই অনুযায়ী মানিয়ে নিতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “আমি আশাবাদী যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিষয়টি সমাধানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করবে। আমি মনে করি যে, এটির জন্য তাদের সদিচ্ছা রয়েছে।”

পেপাল কীভাবে ​​বর্তমানের আর্থিক প্রেক্ষাপটকে প্রভাবিত করতে পারে?

পেপাল বাংলাদেশে ​​কী প্রভাব তৈরি করবে সেটি অনুমান করা কঠিন। তবে এর বেশ কয়েকটি সুবিধা রয়েছে।

অধ্যাপক মইনুল বলেন, “আমি সঠিক সংখ্যা দিতে পারছি না। তবে এটি অবশ্যই আর্থিক খাতকে চাঙ্গা করবে।”

কবির মনে করেন যে, বিকাশ বা নাগদের মতো স্থানীয় মোবাইল আর্থিক পরিষেবা (এমএফএস) পেপালের সাথে যুক্ত হতে পারে।

এই অংশীদারিত্ব বাংলাদেশি প্রবাসীদের জন্য রেমিট্যান্স পাঠানো সহজ করবে।

প্রবাসীদের দেশে থাকা পরিবারগুলো বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দারা

তখন এমএফএস সাভিসের মাধ্যমে টাকা পেতে পারবে। ফলে প্রক্রিয়াটি আরও নির্বিঘ্ন হবে।

পেপাল চালু হলে ফ্রিল্যান্সাররাও উপকৃত হবে। তারা বিশ্বব্যাপী আরও প্রজেক্টে যুক্ত হতে পারবে।

এতে করে তাদের আয়ের সম্ভাবনা বাড়বে। একইসাথে ফ্রিল্যান্স কাজের সুযোগ বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদানের পাশাপাশি আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে।

বারবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও পেপালের মিডিয়া টিমের পক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। একইসাথে আইসিটি বিভাগের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকেও মন্তব্যের জন্য পাওয়া যায়নি।

সুত্র – টিবিএস

মতামত দিন