বগুড়ার শাহনগর গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর সময় এক চমৎকার দৃশ্য চোখে পড়ে– ক্ষেতে ছড়িয়ে থাকা পলিথিনের আস্তরণ দিয়ে ঢাকা ছোট ছোট সবজির চারা এবং বিস্তৃত গ্রিনহাউজ, যা একটি নবাগত শিল্পের ইঙ্গিত।
গ্রামটির কৃষকরা বুদ্ধিমানের মতো তাদের ক্ষেতে ধান চাষের পরিবর্তে চারা উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করেছেন, যা অনেক বেশি লাভজনক।
এটি ১৯৮০-এর দশকে শুরু হয়েছিল একটি সাধারণ উদ্যোগ হিসেবে, স্থানীয়ভাবে শামসু পাগলা নামে পরিচিত একজনের হাত ধরে।
তখন শামসু এলাকায় বিভিন্ন সবজির চারা উৎপাদন করতেন। নিজ জমিতে রোপণের পর অবশিষ্ট কিছু চারা বিক্রিও করতেন। কিন্তু বাণিজ্যিক পরিসর ছিল না তার।
তবে চারা উৎপাদন ও বিক্রি বাণিজ্যিক আকারে হতে পারে; এটি স্থানীয় কিশোর আমজাদ হোসেন ভাবতে শুরু করেন।
শামসুর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অর্ধডেসিমাল জমিতে মরিচের চারা চাষ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
লাভের সম্ভাবনা বুঝতে পেরে, তিনি দ্রুত আবিষ্কার করেন, চারা উৎপাদন অন্যান্য ফসলের চেয়ে লাভজনক।
১৯৯২ সালের দিকে এসে আমজাদ ৪ বিঘা জমিতে বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদনে শুরু করেন।
আজ ৫৩ বছর বয়সী আমজাদ শুধু নিজের জীবনই পরিবর্তন করেননি, বরং গ্রামে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে এসেছেন। বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার শাহনগর এখন “চারার গ্রাম” নামে পরিচিত।
এ গ্রামে এখন ৩০০ নার্সারি গড়ে উঠেছে।
নার্সারি মালিকরা বলছেন, বছরে এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চারা কিনতে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা আসেন। এক মৌসুমে অন্তত ৪০ কোটি টাকার চারা কেনা-বেচা হয় শাহনগরে।
শাহনগরে কৃষি অর্থনীতিতে অবদান রাখা আমজাদ এখন নিজেই এগ্রো সীড প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। সেখানে প্রাথমিক পর্যায়ে ৮ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে।
চারা উৎপাদনের পাশাপাশি এখন এলাকার মানুষকে ভালো মানের সবজির বীজ সরবরাহ করেন আমজাদ।
শাহনগর নার্সারি মালিক উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি হিসেবে আমজাদ লক্ষ্য করেছেন, কিভাবে চারা উৎপাদন অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে একটি বিপ্লব ঘটিয়েছে।
তিনি বলেন, “চারা উৎপাদন সংক্রান্ত কাজের ফলে অনেক বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আগে এই অঞ্চলে বেশিরভাগ জমিতে ধান চাষ হতো। এখন সেই জমিতে চারা উৎপাদন করা হয়। ধানের চেয়ে কয়েকগুণ লাভ হয় চারা উৎপাদনে।”
বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে গণিত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফামিন হোসেন পড়াশোনার পাশাপাশি চারা উৎপাদন ব্যবসায় জড়িত।
ফামিন মাত্র ৮ শতক জমিতে সবজি চারা উৎপাদন করে বছরে তিন থেকে চার লাখ টাকা আয় করেন।
তিনি এই সাফল্যের জন্য শাহনগরের মানসম্পন্ন চারার উচ্চ চাহিদার কথা উল্লেখ করে বলেন, বর্তমানে এলাকার প্রায় প্রত্যেক কৃষকই চারা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত।
চারা বিপ্লব প্রসারিত হচ্ছে
বর্তমানে শাহনগর, বড়পাথার, চুপিনগর ও দুরুলিয়াসহ অন্তত ২০টি গ্রামে গড়ে উঠেছে প্রায় ৩০০টি ছোট-বড় নার্সারি।
এখানে অন্তত ২৫০ থেকে ৩০০ বিঘা জমিতে প্রতি বছর চারা উৎপাদন করা হয়।
শাহনগরসহ আশপাশের এলাকায় বছরের পর বছর ধরে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, পেঁপেসহ হাইব্রিড জাতের মরিচের চারা উৎপাদন করা হচ্ছে।
উৎপাদিত চারা সাধারণত বাংলা আষাঢ় মাস থেকে কার্তিক মাস (জুন থেকে নভেম্বর) পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে।
শীতকালীন সবজির চারা নিতে পঞ্চগড়, বরিশাল, টাঙ্গাইল এবং সাভার অঞ্চল থেকে আসা ক্রেতাদের ভিড়ে মুখরিত থাকে শাহনগর।
স্থানীয় নার্সারির মালিক আরমান হোসেন মিলন বর্তমানে দুই বিঘা জমিতে সবজির চারা উৎপাদন করছেন।
প্রতি বিঘায় চারা উৎপাদনে সব মিলিয়ে খরচ হয় ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। খরচ বাদ দিয়ে তার লাভের পরিমাণ প্রায় একই।
তিনি বলেন, “নার্সারি ব্যবসার আগে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ ধান চাষের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু উপজেলার অন্য এলাকার চেয়ে শাহনগর এখন অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী।”
ধান চাষের পরিবর্তে চারা উৎপাদনে মনোনিবেশ করা কৃষক মোকসেদুল ইসলামেরও একইরকম সাফল্যের গল্প রয়েছে।
বর্তমানে দুই একর জমিতে সবজির চারা উৎপাদন করা মোকসেদুল বলেন, “আমি এক একর জমিতে ধান চাষে প্রায় ১৫ হাজার টাকা ব্যয় করতাম, আয় হতো মাত্র ২০ হাজার টাকা।
যদি ধানের দাম প্রতি মৌন্ড (৩৭ কেজি) ১ হাজার টাকার নিচে নামে, তাহলে আমি লোকসানে পড়ে যাব। এজন্যই আমি চারা উৎপাদন শুরু করি, যা অনেক বেশি লাভজনক।”
স্থানীয় নার্সারি মালিকরা জানান, শাজাহানপুরে প্রতি বছর অন্তত ৩০ কোটি চারা উৎপাদন হয়। চলতি বছর প্রতি ১ হাজার চারা বিক্রি হয়েছে ১২০০ থেকে ২০০০ টাকা দরে।
এই হিসাবে, প্রতি বছর এখানে অন্তত ৪৮ কোটি টাকার চারা বিক্রি হয়।
আমজাদ হোসেন এবং অন্যান্য নার্সারি মালিকরা এখন আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে রোগমুক্ত, উচ্চ ফলনশীল চারা উৎপাদন করছেন।
গ্রিনহাউস পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে সেখানে মাটির পরিবর্তে ‘কোকো পিট’-এ চারা উৎপাদন করে তারা এই সাফল্য অর্জন করেছেন।
আগ্রহ দেখাচ্ছে সরকার
শাজাহানপুরের কৃষি কর্মকর্তা আমিনা খাতুন জানান, শুধু শাজাহানপুরেই প্রায় ৩০০টি নার্সারিতে সবজির চারা উৎপাদন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “এই চারাগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে বিতরণ করা হয় এবং আমরা কৃষকদের সমর্থন ও তাদের কার্যক্রম উন্নত করার জন্য ধারাবাহিকভাবে কাজ করছি।”
উপযুক্তভাবেই শাহনগর বাংলাদেশে বৃহত্তম চারা উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে নিজের সুনাম প্রতিষ্ঠা করছে এবং স্থানীয় কৃষকরা আরো উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী।
প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং কৃষি বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতার ফলে গ্রামটি আগামী বছরগুলোতে ক্রমাগত উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।
সুত্র – টিবিএস