ভোটের প্রস্তুতি জামায়াতের, শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হতে নানা ছক!

৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে জামায়াতসংসদের ভোট কবে হবে, সে নিশ্চয়তা না থাকলেও মাঠ গোছানোর কাজে নেমে পড়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।

এরই ধারাবাহিকতায় নির্বাচনে বিএনপির সামনে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হতে নানা ছক কষছে জামায়াতে ইসলামী।

আওয়ামী লীগবিরোধী দলগুলোকে এক সুতায় গাঁথার চেষ্টা করছে দলটি।

ধর্মভিত্তিক ছাড়াও বিএনপির সঙ্গে একসময় যুগপৎ আন্দোলন করা এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে পাশে রাখতে চাচ্ছে তারা।

এসব দলকে এক প্ল্যাটফর্মে এনে নির্বাচনী জোটে রূপান্তরের পরিকল্পনা জামায়াতের।

এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন করা দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে তাদের কাছে টানছে।

ভবিষ্যতে জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে ছোট-বড় সব দলকে ক্ষমতার অংশীদার করার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে দলটি। তবে বিএনপির জাতীয় সরকারের ভাবনায় জামায়াত নেই।

উল্টো অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করেছে।

এদিকে, জামায়াতের সঙ্গে আদর্শিক দূরত্বের কারণে কয়েকটি দলের কিছু নেতার জোট গঠনে আপত্তি আছে।

জামায়াত আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও দলটির নেতা এবং যেসব দলকে জোটে টানার চেষ্টা চলছে, সেই সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

জামায়াত নেতারা গনমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোটের সম্ভাবনা নেই। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় এবং ভোট পর্যন্ত পরিস্থিতি বদল না হলে নির্বাচন হতে পারে ‘বিএনপি বনাম জামায়াত’।

তবে বিএনপির বিপক্ষে এককভাবে পেরে ওঠা সম্ভব নয়, তাই আওয়ামী লীগবিরোধী সব দলকে নিয়ে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী জোট গঠনের চেষ্টা চলছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করেছেন, যা পরে রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে।

সম্ভাব্য এ দলটি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে না পারলে, ভোটের মাঠে বিএনপির পর জামায়াতই বড় শক্তি হতে পারে।

এককভাবে নির্বাচন করে ১৯৯১ সালে ১২ দশমিক ১ এবং ১৯৯৬ সালের ৮ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল জামায়াত।

পরের দুটি নির্বাচন বিএনপির সঙ্গে জোট করে অংশ নেয়। আদালতের রায়ে নিবন্ধন হারানোর কারণে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হন জামায়াত নেতারা।

দলটির একজন নায়েবে আমির গনমাধ্যমকে বলেন, বিএনপি এককভাবে নির্বাচন করলে বর্তমান পরিস্থিতিতেও ৪৫ শতাংশের বেশি ভোট পাবে না।

জামায়াতের ভোট ১০ থেকে ১২ শতাংশের বেশি হবে না। বাকি ভোটও আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য দলের নয়। বিপুল সংখ্যক ভোটার ভাসমান। বিএনপিবিরোধী ভোট একদিকে আনতে বৃহত্তর জোটের বিকল্প নেই।

সূত্র জানিয়েছে, জামায়াতের সঙ্গে দুই খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম জোটে রাজি।

চরমোনাইর পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনকেও জোটে টানার চেষ্টা চলছে।

তবে দলটির নায়েবে আমির এবং চরমোনাইর পীরের ভাই সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম জামায়াতের সঙ্গে জোটে রাজি নন।

মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ায় জামায়াতের কয়েক নেতা দল ছেড়ে এবি পার্টি গঠন করেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের ঘনিষ্ঠ এ দলটি জামায়াতের সঙ্গে জোটে রাজি নয়।

ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদকে জোটে টানার চেষ্টায় আছে জামায়াত।

গণঅধিকার পরিষদের অন্য অংশের সঙ্গেও আলাপ চালাচ্ছে তারা। জাতীয়তাবাদী সমমনা এবং ১২ দলীয় জোটকেও পক্ষে টানতে চেষ্টা চালাচ্ছে দলটি।

খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন বলেন, ইসলামপন্থি দলগুলোর একটি নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে। সেই লক্ষ্যে কথা চলছে। তবে তা বাস্তবে রূপ পেতে ‘নির্বাচনের চাঁদ’ উঠতে হবে।

হেফাজতে ইসলাম রাজনৈতিক সংগঠন না হলেও কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলো সংগঠনটির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

গত ১৮ আগস্ট জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ‘হাজারো ঐক্য কোনো কাজে আসবে না, যদি না ব্যালটের যুদ্ধে একত্রিত হতে না পারি।’ সেই বৈঠকে অন্য ইসলামী দলের নেতারা একই মনোভাব জানান।

তবে জামায়াতের জোটে যেতে দলগুলোর আপত্তিও আছে।

চরমোনাইর পীরের দলের সূত্র জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে সৌহার্দ্য থাকলেও জামায়াত এবং ইসলামী আন্দোলনের তৃণমূলের নেতাকর্মীর মধ্যে বিভেদ রয়েছে ধর্মীয় প্রশ্নে।

ফলে শেখ হাসিনার পতনের লক্ষ্যে কাছাকাছি এলেও দু’দলের নির্বাচনী জোট করা কঠিন।

একটি ধর্মভিত্তিক দলের নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএনপির সঙ্গে জোটের ক্ষেত্রে ধর্ম বাধা না হলেও জামায়াতের ক্ষেত্রে তা হবে না।

এ কারণে ভাবা হচ্ছে, প্রকাশ্য জোট না হলেও নির্বাচনী সমঝোতা যেন সম্ভব হয়। তবে কবে, কীভাবে নির্বাচন হবে, এর ওপর নির্ভর করবে পরিস্থিতি।

ধর্মভিত্তিক নয়, এমন ছোটগুলোকেও জামায়াতের পক্ষে ধরে রাখা অসম্ভব হবে বলে মনে করেন এবি পার্টির জ্যেষ্ঠ এক নেতা।

তিনি বলেন, জামায়াত ক্ষমতায় যেতে পারবে না। বিএনপি যখন ডাকবে, তখন জাতীয়তাবাদী সমমনা, ১২ দলীয় জোট বা গণতন্ত্র মঞ্চ কেউই তা উপেক্ষা করে জামায়াতের সঙ্গে থাকবে না।

যারা বিএনপির ডাক পাবে না, তারাই হয়তো জামায়াতের জোটে যেতে পারে।

প্রায় ২৫ বছর মিত্রতা থাকলেও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএনপি-জামায়াতের বিরোধ বাড়ছে।

দল দুটির নেতারা একে অপরকে কটাক্ষ করছেন। বিএনপি দ্রুততম সময়ে নির্বাচন চাইলেও জামায়াত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে চাপ না দেওয়ার কথা বলছে।

গত রোববার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অভ্যুত্থানে দলটির ৪২২ নেতাকর্মী জীবন দিয়েছেন।

পরের দিনই জামায়াত আমিরের জবাব আসে, ‘শহীদরা কোনো দলের নয়, দেশের সম্পদ।’

এর আগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘কিছু রাজনৈতিক দল পাশের দেশের ফাঁদে পা দিয়ে কিছুদিন ধরে উল্টাপাল্টা বকছে।’

শুধু শীর্ষ নেতারা নন, বিএনপি ও জামায়াতের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও বাগ্‌যুদ্ধ চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

তবে দু্’দলের কয়েক নেতার মূল্যায়ন, মাঠে আওয়ামী লীগ না থাকায় গণতন্ত্রের স্বার্থে বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকা জরুরি।

নয়তো জাতীয় পার্টি যেভাবে আওয়ামী লীগের ‘গৃহপালিত বিরোধী দলে’ পরিণত হয়েছিল, সেই অবস্থার উদ্ভব হতে পারে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে জামায়াতসহ সবাইকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয় বিএনপি।

পাশাপাশি জামায়াত ও শিবিরকে নিষিদ্ধেরও নিন্দা করে। তবে হাসিনা সরকারের পতনের পর দু’দলের পথ ফের আলাদা হয়ে যায়।

জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের  বলেন, বিএনপির সঙ্গে শত্রুতা হয়নি, সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে। দু’দল যে যার আদর্শ নিয়ে কাজ করছে।

স্বৈরাচার-পরবর্তী বাংলাদেশ গড়তে ঐক্য প্রয়োজন। এজন্য জামায়াত সবার সঙ্গেই কথা বলছে। জোট হবে কিনা, তা নির্বাচনের সময় বলা যাবে।

৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে জামায়াত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেছেন, ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তবে যদি ইসলামী দলগুলো কিংবা ভিন্ন দলগুলো নির্বাচনে সহযোগিতা চায় তাহলে জামায়াতে ইসলামী তাদেরও সহযোগিতা করবে।’

গত ৯ সেপ্টেম্বর সিলেটের বিয়ানীবাজার পৌর শহরের একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টের হলরুমে বিয়ানীবাজারে কর্মরত প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সঙ্গে বিনিময়সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

মতবিনিময়সভায় মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘বিগত সরকার দেশকে কেবল পেছনের দিকে নিয়ে গেছে।

সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণ করে দেশে সহিংস ও প্রতিহিংসার রাজনীতি শুরু করেছে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের সাধারণ মানুষ এক নতুন বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে।’

আগামী নির্বাচনে সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) আসনে সম্ভাব্য সংসদ সদস্য পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইচ্ছা পোষণ করে তিনি বলেন, ‘বিজয়ী হলে বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জকে একটি আধুনিক-আদর্শ জনপদ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করব।

উল্লেখ্য, ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ৭৬টি আসনে মনোনয়ন দিয়েছিল। ওই নির্বাচনে দলটি ১০টি আসনে বিজয়ী হয়।

১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে জামায়াত।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসনে বিজয়ী হয়। এই নির্বাচনে দলটি ২২২ জন প্রার্থী দিয়েছিল।

১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত তিনটি আসনে জয়ী হয়। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে জামায়াত ১৭টি আসন পায়।

মহিলা আসনগুলো থেকে চারটি আসনে জয়ী হয় তারা। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত দুটি আসনে বিজয়ী হয়। ওই নির্বাচনে দলটি জোটগতভাবে ৩৯টি ও চারটিতে এককভাবে নির্বাচন করে।

মতামত দিন